Physician | Author | Blogger

আয়নাঘর-এর বুনিয়াদে শাহবাগের স্বপ্ন

এক নজরে

সমাজবিজ্ঞানী জিগমুন্ড বাওম্যানের (Zygmunt Bauman) নাম আমাদের দেশে সমাজবিজ্ঞান বিভাগে যারা পড়াশোনা/শিক্ষকতা করছেন তারা জানেন কিনা তা আমার জানা নেই। আধুনিকতা ও ওর অনুসঙ্গ নিয়ে পড়তে গিয়ে তার লেখার সাথে আমার পরিচয় ঘটে। পুরস্কারপ্রাপ্ত এই সেক্যুলার সমাজবিদের বইগুলোর মাঝে অন্যতম একটি হলো মডার্নিটি এন্ড হলোকাস্ট (১৯৮৯)। এই বইতে তিনি দেখিয়েছেন নাৎসি প্রধানের ইচ্ছায় গড়ে উঠা কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প আসলে আধুনিকতারই সম্ভাবনা। যুক্তিবাদি সেক্যুলার সমাজ ছিল এর প্রাণশক্তিতে। বাওম্যান লিখেছেন,

“হলোকাস্টের জন্ম হয়েছিল আমাদের আধুনিক যুক্তিপ্রবণ সমাজে, আমাদের সভ্যতা ও সংস্কৃতি যখন শিখরে আরোহণ করেছিল। তাই এই নিধনযজ্ঞ আমাদের আধুনিক সমাজ, সভ্যতা ও সংস্কৃতিরই সমস্যা। আধুনিক সমাজের মানব ইতিহাসের এই ক্ষত যে ভুলে গেছে তা কেবল নিছক অবজ্ঞা বলা চলে না, বরং এই বিস্মৃতি গণহত্যার শিকার হওয়া মানুষগুলোর প্রতি এক অন্যায়। এটি ভয়ংকর ও আত্মবিধ্বংসী নির্বুদ্ধিতা।”

পোলিশ এই সমাজবিদ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় রাশিয়ায় পালিয়ে যান যখন জার্মানি পোল্যান্ডে হামলা চালায়। রাশিয়ার নেতৃত্বে থাকা পোলিশ বাহিনীর অংশ হয়ে তিনি যুদ্ধেও অংশ নিয়েছিলেন। হলোকাস্টে নিহত হওয়ার তালিকায় উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ইহুদি না থেকে মুসলমানরা থাকলে বাওম্যান উপরের সিদ্ধান্তে আসতেন কিনা জানা নেই। তবে অন্তত বিদ্যমান কাজ থেকে আমরা সেক্যুলার জাতিবাদের সম্ভাবনাটা বুঝতে পারি। দুইটি বিশ্বযুদ্ধ ছাড়াও, অজস্র যুদ্ধ-প্রকাশ্য বা গোপন, স্যাংশান স ন্ত্রা স এসবই আধুনিক সমাজের অস্তিত্বের অংশ।

সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধ বা ওয়ার অন টেরর নামক সাম্রাজ্যবাদী প্রকল্প শুরুই হয়েছে জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে। এ বিষয়ে রাজনীতি-ব্যবসায়ীদের বক্তৃতা, একাডেমিকদের বিশ্লেষণে তা দিনের আলোর মতই স্পষ্ট। এটা ছিল একটি আক্রমনাত্মক প্রকল্প। নারীবাদি তাত্ত্বিক ফালগুনি শেঠ স্বাক্ষ্য দিতে বাধ্য হয়েছেন:

“ওয়ার-অন-টেরর কেবল জঙ্গিবাদ দমনের জন্য শুরু হয় নি। আদতে পশ্চিমের সেক্যুলার-লিবারেল সংস্কৃতি রক্ষা ও এর প্রতি হুমকিকে নির্মূল করার জন্য এর সূচনা।”

মার্কিন মুলুক অনেককেই আয়নাঘরের বন্দী বানিয়েছে। সিক্রেট রেনডিশান ও ডিটেনশান লিবারেলদের খুব কমন প্র‍্যাকটিস। সবগুলোর পিছে ছিল একই যুক্তি: জাতীয় স্বার্থ, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা ইত্যাদি ইত্যাদি। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা ও সহযোগী সরকার দ্বারা গুমের শিকার হওয়া ১৩০ জনের তথ্য সংগ্রহ করতে পেরেছে Justice initiative। আরো কত ব্যক্তির কথা জানা যায় নাই খোদাই জানেন। মুক্তমনা মুভমেন্টের সূচনাকারী মার্কিন গুরু স্যাম হ্যারিসও উদাত্তভাবে টেররিস্টদের ওপর ইন্টেরোগেটিভ টর্চার সমর্থন করতেন। বলাই বাহুল্য কে টেররিস্ট আর কে না তা নিয়ে একাডেমিক বিতর্কে মোটেও তারা আগ্রহী না। তাদের কাছে টেররিস্ট মানেই মুসলমান। মুসলমান মাত্রই “ব্যাড” মুসলিম।

কেন বাংলাদেশের থাকা আয়নাঘরগুলোর প্রসঙ্গে এই আলাপ আসছে?

কারণ এখানের আয়নাঘরের যৌক্তিকতাও তাই। শাহবাগীরা যা চেয়েছে তারই ফলাফল আয়নাঘর।

জাতীয় নিরাপত্তা, স্বাধীনতার চেতনা রক্ষার্থে সম্ভাব্য মৌলবাদী, পাকিস্তানপন্থী, জঙ্গিদের আগে থেকে শনাক্ত করে নিউট্রালাইজ করে ফেলা। অজস্রবার দেখা গেছে কারো গুমের সংবাদ এলেই অসাম্প্রদায়িকরা আনন্দে মেতে উঠে জঙ্গি ধরা পড়েছে বলে। (খুশি হয় এক শ্রেণির মুসলমানরাও। যদিও এই দুইদলের দার্শনিক ভিত্তি ভিন্ন)

দেশে আয়নাঘর ইস্যুটা ট্রেন্ডি হবার কারণে দেশপ্রেমিক, জাতিবাদি, মুক্তচিন্তকরা যতই বিরোধীতার নাটক করে দেখাক, বাস্তবতা হলো আয়নাঘর সেক্যুলার সমাজেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ। মুসলমানরা চিন্তার স্বাধীনতা বুঝে না, সেক্যুলারিজম বুঝে না, তাদের মধ্যে বাক স্বাধীনতার কোনো ধারণা নাই, নারীদের বন্দী করে রাখে, বিধর্মীদের নির্বিচারে সং হার করে, গাদা গাদা বাচ্চা নেয়—এসব বর্বরকে শায়েস্তা করা আলোকিত, প্রগতিশীল সমাজ গড়ার পূর্বশর্ত।

আয়নাঘর তাই —

স্বাধীনতার চেতনা রক্ষার জন্য

জাতীয় নিরাপত্তার জন্য

মুক্তচিন্তার জন্য

বাক স্বাধীনতার জন্য

অসাম্প্রদায়িকতার জন্য

মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য

প্রগতিরই জন্য।

Share This
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp
Share on email
Related Articles
Recent Articles

রাফান আহমেদ-এর বইসমূহ

আলাদাবইওয়াফিলাইফ

Copyright © Rafan Ahmed

No part of the website or posts can be published elsewhere without prior permission from author.  

Copyright © 2021 All rights reserved

error: Content is protected !!