মঙ্গল শোভাযাত্রার ইতিহাস খুবই সাম্প্রতিক কালের। বলা হয়ে থাকে ১৯৮৯ সালের দিকে এরশাদের স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক সমাবেশে ব্যর্থ হয়ে সাংস্কৃতিক উইং থেকে এক্টিভিজম চালাতে শুরু হয় মঙ্গল শোভাযাত্রা। বিদ্রোহের প্রতীক হিসেবে বেছে নেয়া হয় উপনিবেশকালে দাঁড় করানো বাঙালি পরিচয় তথা বর্নহিন্দুর সংস্কৃতির বিভিন্ন প্রকাশকে। স্বৈরাচারের মোকাবিলায় এক বুক স্বপ্ন নিয়ে মাঠে নামতে শুরু করে প্রগতিশীল অসাম্প্রদায়িক কালচারাল ফ্রন্ট।
কিন্তু আসলেই কী প্রগতিশীলরা স্বৈরাচার বিরোধী?
দেশের প্রগতিশীলরাই শুধু খারাপ পশ্চিমেরগুলো নয়?
না, মোটেই না। তারা নিজেরাও প্রো-স্বৈরাচারীই বটে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কে স্নাতক এক ছাত্রের পাঠ থেকে একটু খুলে বলা যাক। ঈষৎ পরিমার্জনা সহ লেখাটি উল্লেখ করলাম:
পলিটিকাল ফিলসফি এবং সাম্প্রতিক বিষয়াবলী একাধারে পাঠ করতে যেয়ে মিশরে, তিউনিশিয়ায়, তুরস্কে, সৌদিতে, পাকিস্তানে – সর্বত্র দেখি প্রগতিশীলরা গণতন্ত্র এবং বাকস্বাধীনতার বিরুদ্ধে। এক পর্যায়ে ভাবলাম এটা বোধহয় মুসলমান বিশ্বের সমস্যা। মুসলমান বিশ্বের প্রগতিশীলরা তাহলে ঠগ। কিন্তু আরও পড়াশোনা করতে যেয়ে দেখি, এটা খোদ প্রগতিশীলতারই সমস্যা।
২০১৩-তে মিশরের একমাত্র নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ মুরসিকে সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত করে জেনারেল সিসি রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে। সিসি প্রকাশ্য দিবালোকে এক হাজারের বেশি মুরসি সমর্থককে হত্যা করে কায়রোর রাবা স্কয়ারে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলছে আধুনিক মিশরের ইতিহাসে এটা সবচেয়ে বড় ম্যাসাকার। মিশরের প্রগতিশীলরা গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে সেনা অভ্যুত্থান এবং ম্যাসাকারকে সানন্দে সমর্থন জানায়। এতে করে পশ্চিমে অবস্থিত লিবারেলরা লজ্জায় পড়ে যায়। তারা অনেকে বলা শুরু করে মিশরীয় লিবারেলরা প্রকৃত লিবারেল না।
এ প্রেক্ষিতে বিলাতে বসবাসরত তাত্ত্বিক ফাহিম এ হুসেইন একটা ব্লগ লিখেন যেটা পরবর্তীতে ওপেন ডেমোক্রেসিতেও প্রকাশিত হয়। ফাহিম এ হুসেইন লিবারেলিজমের ইতিহাস ঘেঁটে দেখান যে মিশরের লিবারেলরাই প্রকৃত লিবারেল। পশ্চিমের প্রগতিশীলরা যদি এনলাইটেনমেন্ট ফিলসফির শুরুর দিকের ইতিহাসে ফিরে তাকান, তাহলে তারা দেখতে পাবেন যে মিশরের সেকুলাররা আজকে যেরকম আচরণ করছে পশ্চিমের প্রথম দিকের সেকুলাররাও ঠিক এমন আচরণ করেছে।
ফাহিম এ হুসেন জন লক থেকে শুরু করে একদম শুরুর দিকের সেকুলার-লিবারেল চিন্তকদের উদাহরণ দিয়ে দেখান যে প্রগতিশীলরা সবসময় “অশিক্ষিত, মূর্খ, কুসংস্কারাচ্ছন্ন, বর্বর” জনগনের চেয়ে স্বৈরাচারকে বেছে নিয়েছে। স্বৈরাচার যদি এই প্রগতিশীলদের এনলাইটেন্ড, র্যাশনাল লাইফস্টাইলের নিরাপত্তা দিতে রাজি হয় তাহলে বিনিময়ে এই প্রগতিশীলরা স্বৈরাচারকে সমর্থন দিয়েছে। মিশরের লিবারেলরাও ঠিক একই কাজ করছেন।
ক্লাসিকাল লিবারেলিজমের ওপর মারাত্মক দখল রাখা অধ্যাপক ড্যানিয়েল পেল্লারিনকে এক সাক্ষাতকারে জন স্টুয়ার্ট মিলের ফ্রিডম অব স্পিচ নিয়ে বক্তব্য শেষে প্রশ্ন করা হয়। প্রশ্নোত্তর পর্বের শেষ দুইটা অংশ ছিল গণতন্ত্রের সাথে বাকস্বাধীনতার সম্পর্ক নিয়ে। ড্যানিয়েল বলে যে ঐতিহাসিকভাবে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার চেয়ে স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থাই বাকস্বাধীনতাকে বেশি সমুন্নত রেখেছে। এ পর্যায়ে আমি বলি যে, এই আর্গুমেন্ট দিয়েই তো মুসলমান বিশ্বে স্বৈরাচারকে বৈধতা দেওয়া হচ্ছে। ড্যানিয়েল খুব এক্সাইটেড হয়ে বলল যে, এবসলুটলি, মুসলমান বিশ্বে গণতন্ত্রের চেয়ে স্বৈরশাসনই উত্তম এই কারণে। ইউরোপীয় দেশগুলি ঠিক এই দার্শনিক কারণেই আরব দেশগুলিতে স্বৈরাচারকে সমর্থন করে। সামগ্রিকভাবে প্রশ্নোত্তর পর্ব এমনভাবে আগায় যে ড্যানিয়েল পরে আমার সাথে ব্যক্তিগত আলাপরিচতায় বলে যে সে উপলব্ধি করতে পেরেছে তার রাজনৈতিক দর্শন চিলির কুখ্যাত একনায়ক পিনোশের রাজনীতির কাছাকাছি যদিও সে নিজেকে লিবারেল মনে করে।
বাংলাদেশে ২০১৩ থেকে সেকুলারিজম বনাম গনতন্ত্র বিতর্ক খুব জোরেশোরে চালু হলে বহু লোক সরাসরি সেকুলারিজমের পক্ষ নিয়ে গণতন্ত্রের বিরোধিতা শুরু করেন। এর মধ্যে খানিকটা ব্যতিক্রম ছিলেন বিনায়ক সেন। বিনায়ক সেন ২০১৪ সালের ১লা জানুয়ারীতে দৈনিক সমকালে প্রকাশিত তাঁর কলামে একইসাথে সেকুলারিজম এবং গণতন্ত্র দুইটার পক্ষেই ওকালতি করেন। সেই কলামে তিনি কন্টেম্পরারি পলিটিকাল লিবারেলিজমের বিখ্যাত পণ্ডিত জন রলসের (John Rawls) এর বরাত দিয়ে “চরম সহিংস ডানপন্থী প্রতিক্রিয়াশীল” শক্তিকে গণতন্ত্রের বাইরে রাখার দাবী জানান। অর্থাৎ, উনি গণতন্ত্র চান কিন্তু ওনার অপছন্দের মানুষগুলিকে বাদ দিয়ে গণতন্ত্র চান। এবং এটা তিনি চান রলসিয়ান পলিটিকাল লিবারেলিজমের reasonable pluralism অনুসারেই।
ইতিহাসের দিকে তাকান।
১৮৫৭ সালে যখন সিপাহী বিপ্লব সংঘটিত হয় তখন কি দেখি আমরা? আধুনিক শিক্ষিত প্রগতিশীল ভারতীয়রা কি সেই বিপ্লবে অংশ নিয়েছিল? নাকি তারা ব্রিটিশদের দালালি করেছিল? তারা ব্রিটিশদের দালালি করেছিল কারণ সিপাহী বিপ্লবের সিপাহীরা ছিল অনাধুনিক, পশ্চাদপদ, রক্ষনশীল, কুসংস্করাচ্ছন্ন। অর্থাৎ, খ্যাত ধার্মিকদের এই বিপ্লবে সমর্থন দেওয়ার চেয়ে ব্রিটিশদের গোলামী করা প্রগতিশীল ভারতীয়রা অধিকতর বেহতর অপশন হিসাবে মেনে নেন।
তুরস্কে সিরীয় শরনার্থী, আফ্রিকান ব্যবসায়ী ও ইমিগ্র্যান্টদের বিরুদ্ধে সহিংসতা উসকে দিচ্ছে তুরস্কের প্রগতিশীলরা। অন্যদিকে এরদোয়ান নেতৃত্বাধীন ইসলামপন্থীরা সেটা দমাতে চাচ্ছে। ভোটের রাজনীতিতে না পেরে অনেকসময় সিরীয় শরনার্থী এবং আফ্রিকান ইমিগ্র্যান্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হচ্ছে এরদোয়ানকে। তুর্কি প্রগতিশীলদের এই রেসিস্ট রাজনীতিকে সমর্থন দিচ্ছে পশ্চিমা বিশ্ব।
প্রগতিশীলতার জন্য এবং ধর্মের বিরোধিতায় সব অন্যায়, সব জুলুম মেনে নেওয়া যায়।
সারা পৃথিবীজুড়ে প্রগতিশীলতা তাই রাবা স্কয়ারের মত ম্যাসাকার উপহার দিয়ে যাচ্ছে। কলোনিয়ালিজমের মত বীভৎসতা রেখে যাচ্ছে। বাংলাদেশের প্রগতিশীলরা প্রকৃত প্রগতিশীল না এটা আসলে ভুল দাবী। বরং বাংলাদেশের প্রগতিশীলরা প্রকৃত প্রগতিশীল জন্যই তারা এত ভয়ংকর, কুতসিত ও হিংস্র। আসলে প্রগতিশীলতার ইতিহাস সম্পূর্নটাই সহিংসতা আর বীভৎসতার ইতিহাস। বাংলাদেশের এমন কোন শহুরে মধ্যবিত্ত শিক্ষিত বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছেলে বা মেয়ে পাওয়া যাবে না যে গণতন্ত্রের স্বার্থে তার স্লিভলেস পরার স্বাধীনতা বিসর্জন দেবে। বরং এদের প্রত্যকে বলবে এক কোটি মোল্লাকে খু*ন করে হলেও তাকে স্লিভলেস পরার স্বাধীনতা এনে দেওয়া হোক।জন লক বা জন স্টুয়ার্ট মিলও ব্যতিক্রম ছিলেন না।
নববর্ষের চেতনাধারীরা আসলে স্বৈরাচারবিরোধী নন, যে স্বৈরাচার তাদের স্বাধীনতা দেয় তার পক্ষেই তাদের এক্টিভিজম।