ভারত কেন ভাগ হলো—এই প্রশ্নের জবাব পেতে হলে আমাদের চলে যেতে হবে অতীতে—কয়েক হাজার বছরের পুরোনো ভারতে। আমাদের চলে যেতে হবে সেইদিনের ইতিহাসে যেদিন এই ভারতের মাটি লাল হয়ে উঠেছিল আর্যের হাতে নিপীড়িত অনার্যের রক্তে। … বলা হয়ে থাকে, ভারতের প্রথম সভ্যতা আর্যরাই প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আর্যরা ভারতকে সুসভ্য করবার জন্য কোথা থেকে ভারতে এলেন, সে-সম্বন্ধে অনেক জল্পনা-কল্পনা আছে বটে, কিন্তু ভারতে আসবার আগে তাঁদের জন্মস্থানকে তাঁরা কতখানি সুসভ্য করতে পেরেছিলেন সে-সম্বন্ধেও ইতিহাসে কোনো ইঙ্গিত নেই। ‘আর্য’ কর্থাট নাকি এসেছে পারস্য দেশের ‘আরিয়স’ শব্দটি থেকে। কিন্তু পারস্যের ভাষায় ‘আরিয়স’ মানে অভিজাত—ওটা কোনো জাতিজ্ঞাপক বাক্যই নয়। …
হিটলারও জার্মানদের এই আর্য-বংশসম্ভূত বলে জাহির করতেন। জার্মানদের আর্যত্বের পবিত্রতা রক্ষা করবার জন্য তিনি লক্ষ লক্ষ ইহুদি নর-নারী ও শিশুর প্রতি যা করেছিলেন তা কেবল হাজার হাজার বছর আগে আর্যরা অনার্যদের প্রতি যা করছিলেন তার সঙ্গে তুলনা করা চলে। কিন্তু যেমন জার্মানীর শ্রেষ্ঠ সন্তানদের মধ্যে বেশির ভাগই ছিলেন হিটলারের আর্য-বংশ বহির্ভূত, তেমনি ভারতে অনার্যরা প্রাক-আর্য যুগ থেকেই সভ্য-জাতি হিসাবে বাস করছিলেন। এই প্রাক-আর্য সভ্যতার আকর্ষণেই আর্যরা এ ভারতে প্রবেশ করোছলেন অন্য দেশ থেকে। যেমন মুসলমানরা পরে অন্য দেশ থেকে ভারতে প্রবেশ করেছিলেন, তেমনি আর্যরাও এদেশে বহিরাগত।
স্বামী বিবেকানন্দ অবশ্য বলেছেন, আর্যরা ভারতেরই লোক—“সমস্ত ভারতই আর্যময়”। কিন্তু অনার্যদের প্রতি আক্রমণের কথা এবং তাদের প্রতি আর্যদের আচরণ-যা বেদে বার বার উল্লেখ করা হয়েছে, সে সম্বন্ধে তিনি কোথাও কিছু বলেন নি। তাঁর মতে আর্যদের আদিম বাসস্থান ছিল আফগানিস্তান এবং সে সময়ে আফগানিস্তান ভারতেরই অংশ ছিল। ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে আর্যরা সভ্যতা বিস্তার করেছিল বলে বলা হয়, কিন্তু আফগানিস্তানে আর্য সভ্যতার আদম রুপটি কী ছিল, বিবেকানন্দ তা বলেন নি।
বলা হয়ে থাকে, আর্য-হিন্দুরা চিরদিন শান্তিপ্রিয় এবং আবহমানকাল ধরে তাঁরাই পৃথিবীতে শান্তির বাণী বহন করে এনেছেন। কিন্তু এদেশে আর্যদের জীবনপ্রভাত শুরু হয়োছিল নিরীহ শান্তিপ্রিয় অনার্য অর্থাৎ দাস বা দস্যুজাতির রক্তসিঞ্চনে। বেদে আর্যদের হাতে এই নিরপরাধ দাস ও দস্যুজাতির হত্যালীলার চিত্রটি সুপরিস্ফুট হয়েছে। … বেদ বলেছে, দাস ও দস্যুজাতিকে অর্থাৎ অনার্যকে ‘হত্যা করাই ধর্ম’। বেদের বহু মন্ত্রে দাস ও দস্যুজাতিকে হত্যা করবার শক্তি ও সুযোগ প্রার্থনা করা হয়েছে দেবতার কাছে। বিশেষত ঋকবেদ ও অথর্ববেদে। … অনার্যদের মধ্যে যাঁরা আর্য প্রভুত্ব স্বীকার করে নিতেন তাঁরাই ছিলেন দাস-যাঁরা করতেন না, তাঁরা দস্যু। বহিরাগত আর্যরা দাস ও দস্যুজাতির এই যে হত্যাযজ্ঞ শুরু করেছিলেন বহু সহস্র বছর আগে, এতেই ভারতীয় সমাজজীবনে বিভেদের বীজ প্রথম থেকেই আরোপিত হয়ে রইল। … যে সকল দাস ও দস্যুকে আর্যরা ধ্বংস করতে পারলেন না অথচ যারা আর্য প্রভূত্ব স্বীকারও করল না-তাদের রেখে দেওয়া হলো সমাজের অন্তজ-অস্পৃশ্য করে। তাঁদের মারা হোলো না, শধু; কেড়ে নেওয়া হলো তাঁদের মনুষ্যত্বের মর্যাদাটুকু। এইভাবে কায়িক পরিশ্রম দিয়ে যারা সমগ্র সমাজ-জীবনকে বাঁচিয়ে রাখতো-চাষী, তাঁতী, কুমোর, কামার, স্যাকরা, গয়লা, ধোপা, নাপিত এমনকি স্থপতি ও শিল্পীদেরও আর্য-ভারতে অন্ত্যজ-অস্পৃশ্য করে দেওয়া হলো। সেইজন্য স্বাভাবিক কারণেই ভারতীয় সমাজ-জীবনের প্রথম প্রভাত থেকেই এক বিরাট জসমষ্টি দেশের ও সমাজের প্রতি বিমুখ হয়ে অন্তরে অন্তরে শত্রু হয়ে রইল। …
ব্রাহ্মণ্যধর্মের যুগে দরিদ্র অস্পৃশ্য শূদ্র শ্রমিকের জীবন বিভীষকাময় হয়ে উঠলো। ধর্মীয় অনুশাসনের কঠিন নিগড় দিয়ে তাদের জীবনকে এমনভাবে বেঁধে দেওয়া হলো যে, এই জীবন্ত নরক থেকে মুক্তি পাবার কোনো উপায়ই তাদের রইল না। বৌদ্ধদের উপরেও হিন্দু নৃপতিরা কম অত্যাচার করতেন না। বুদ্ধের পূজা বা গুণগান করলে প্রাণদণ্ডের ব্যবস্থা হতো। এমন-কি শিল্পী ও কুশলীদের জীবনও বিষময় করে তোলা হলো। বুদ্ধের পূজা করলে যে প্রাণদণ্ড বা নির্বাসন দেওয়া হতো তার উল্লেখ করে রবীন্দ্রনাথের অনবদ্য হদয়স্পশর্শ কবিতা ‘শ্রীমতী’র কথা নিশ্চয়ই কেউ ভুলতে পারবেন না।
কিন্তু এইভাবে বুদ্ধভক্তেরা ও দরিদ্র শূদ্র শ্রমিক অস্পৃশ্যরা ধীরে ধীরে দেশ ও সমাজীনবন থেকে নিশ্চিতভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেন। দেশময় এই সামাজিক বিচ্ছিন্নতার সংবাদ সেই প্রাচীন যুগেও বিশেষ চেপে রাখা যায়নি। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে ছাড়িয়ে পড়েছিল। সেই সংবাদের সূত্র ধরেই ভারতে মুসলমান আক্রমণ শুরু হয়। যখন মহম্মদ-বিন-কাসিম প্রথম সিন্ধু আক্রমণ করেন, এ বিষয়ে ইতিহাসে উল্লেখ আছে যে, সিন্ধু দেশের কিছু অধিবাসী তখন মহম্মদ বিন-কাসিমকে পরোক্ষে সাহায্য করেছিলেন। এইজন্যই স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন:
এমন-কি মুসলমান অধিকারেও এই একচেটিয়া অধিকাররাহিত্যরুপ মহা সুফল ফলিয়াছে। আর মুসলমান রাজত্ব-যে প্রকৃত- পক্ষে সম্পূর্ণ মন্দ ছিল তাহাও নহে—জগতের কোনো জিনিসই সম্পূর্ণ মন্দ নহে, কোনো জিনিসই সম্পূর্ণ ভাল নহে। মুসলমানের ভারতাধিকার দারিদ্র পদদবিতদের উদ্ধারের কারণ হইয়াছিল। এইজন্যই আমাদের এক পণ্চমাংশ ভারতবাসী মুসলমান হইয়া গিয়াছিল। কেবল তরবারির বলে ইহা সাধিত হয় নাই। কেবল তরবার ও বন্দুকের বলে ইহা সাধিত হইয়াছল, একথা মনে করা নিতান্ত পাগলামি মাত্র।
ভারতে বিবেকানন্দ, পৃ ৩২৭-২৮
… অতএব মুসলমান আক্রমণের প্রথম থেকেই দেশের দরিদ্র পদদলিতেরা মুসলমানদের স্বাগত জানিয়েছিল এবং কয়েকশ’ বছরের মুসলমান রাজত্বে দেশের কয়েক কোটি নিপীড়িত অস্পৃশ্য-শূদ্রের দল স্বেচ্ছায় ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলেন। মুসলমান আক্রমণের সময়ে স্বাভাবিকভাবেই কিছু অত্যাচার হয়েছিল, কিন্তু হিন্দু সমাজের অত্যাচারিত শুদ্র অস্পৃশ্যদের কাছে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ একটা জীবন্ত নরক থেকে মুক্তির পথ হিসাবে প্রতিভাত হয়েছিল।
১০০১ সালে গজনীর মাহমুদ ভারত আক্রমণ করে মুসলমান সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার সূত্রপাত করলেন। কয়েকশ’ বছরের মুসলমান রাজত্বে কয়েক কোটি শূদ্র-অস্পৃশ্য মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করলেন বটে, কিন্তু সাধারণভাবে মুসলমানদের সঙ্গে হিন্দুদের অর্থাৎ উচ্চবর্ণের হিন্দুদের সামাজিক মিলন কখনও সম্পূর্ণ হতে পারেনি। তার প্রধান কারণ, অন্য ধর্ম ও সমাজস্থ ব্যক্তিকে আপন সমাজের সঙ্গে আত্মস্থ করে নেবার যে স্বাভাবিক ক্ষমতা সেটা ব্রাহ্মণ্যধর্মের পুনরভ্যুত্থানে ভারতবর্ষ থেকে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল । এত সামাজিক বিরোধ সত্ত্বেও মুসলমান রাজত্বে বহুক্ষেত্রে উচ্চবর্ণের হিন্দু সমাজপতিরা মুসলমান দরবারে মন্ত্রীর পদ গ্রহণ করেছিলেন এবং এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে মুসলমান নবাব-বংশের সঙ্গে বৈবাহিক সম্বন্ধও স্থাপন করেছিলেন।
বিমলানন্দ শাসমল, ভারত কী করে ভাগ হলো, পৃ. ১৭-১৮, ২৪-২৫ (ঢাকা: আদর্শলিপী, ফেব্রুয়ারি ২০২১ – ১ম বাংলাদেশ সংস্করণ)