Physician | Author | Blogger

রুধিরস্রোতের মহাকাব্য

এক নজরে

স্বাধীনতা পরবর্তী হত্যালীলার প্রথম তরঙ্গটি প্রবাহিত হয়েছিল সম্মিলিতভাবে সকল ধারার ‘মুক্তিযোদ্ধা’দের দ্বারা উর্দুভাষীদের ওপর। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের আগেই আওয়ামী লীগ ও পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠীর মাঝে রাজনৈতিক দরকষাকষি যতই দুরূহ হয়ে উঠছিল ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন স্থানে ‘বিহারি’ নামে পরিচিত উর্দূভাষীদের ওপর বিচ্ছিন্নভাবে আক্রমণ ততই বাড়ছিল। চট্টগ্রামের ছাত্রলীগ মেতা ডা. মাহফুজুর রহমান সেই বিবরণ দিয়েছেন এভাবে:

১ মার্চ ইয়াহিয়া জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণার পরপরই… পথেঘাটে পশ্চিম পাকিস্তানিদের দোকান লুট হয়। বিভিন্ন স্থানে অবাঙালিদের ওপর হামলা শুরু হয়।

উল্লেখ্য, এসময় ছাত্রলীগ ও শ্রমিক লীগের তরুণ স্বাধীনতাপন্থীদের অন্যতম একটি শ্লোগান ছিল ‘একটা দুইটা মাউরা ধরো, সকাল-বিকাল নাতা করো’, ‘মাউরাদের হত্যা করো – বাংলাদেশ স্বাধীন করো’। ‘মাউরা’ হলো উর্দূভাষীদের প্রতি গালিসুলভ একটি শব্দ। এসময় সান্তাহার, দিনাজপুর ও সিরাজগঞ্জে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী মাঠ পর্যায়ে পৌছানোর আগেই কয়েক হাজার ‘বিহারি’ খুন হয়ে যায়।(১) সেসময় চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন স্থানে ‘বিহারি’দের পক্ষ থেকেও পাল্টা হামলার ঘটনা ঘটেছে।

এই জনগোষ্ঠীর ওপর মুক্তিযোদ্ধাদের তরফ থেকে পদ্ধতিগত একতরফা হত্যালীলার অভিযোগ ওঠে মূলত একাত্তর সালের ১৬ ভিসেম্বরের পরে, বিশেষ করে ভারতীয় বাহিনী প্রত্যাহার শেষে। সবচে সংগঠিত ও ব্যাপকতর হত্যাকাণ্ডটি ঘটেছিল ১৯৭২ সালের ১০ মার্চ দিবাগত রাতে খুলনার খালিশপুরে ভারতীয় বাহিনী প্রত্যাহারের পরপর৷ অভিযোগ রয়েছে, প্রায় ১০ হাজার কলোনিবাসী শ্রমিক ও তাদের পরিবার-পরিজন খুন হন তাতে। হত্যাকারীরাও ছিলেন শ্রমজীবী । খালিশপুরের হত্যালীলার কথা পরদিন বিবিসি থেকে প্রচার হলে আন্তর্জাতিক পরিসরে ব্যাপক উদ্বেগ তৈরি হয়- তবে এই ঘটনার কোনো অভিযোগ দায়ের হয়নি, কোনো তদত্ত হয়নি এবং কেউ গ্রেফতারও হয়নি কখনো। ঐ সময়ের সংবাদপত্র থেকে দেখা যায়, বিচ্ছিন্নভাবে যুদ্ধোত্তর অনেক মাস জুড়ে উর্দুভাষীদের প্রতি এরূপ আক্রমণ চলে নিয়মিতভাবে। এইরূপ হত্যার জন্য কাউকে যাতে জবাবদিহিতার মুখে পড়তে না হয় সেজন্য তৎকালীন সরকার ১৯৭৩ সালের এক আইনে তারিখ পিছিয়ে দিয়ে ১৯৭১ সালের ১ মার্চ থেকে ১৯৭২ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ‘জাতীয় স্বাধীনতার সংগ্রামের অংশ হিসেবে’ এবং ‘শান্তি-শৃঙ্খলা বজায়ের স্বার্থে’ কৃত কাজকে আদালতে প্রশ্নযোগ্য নয় বলে ঘোষণা করে।(২)

এই আইন উর্দুভাষীদের বিরুদ্ধে সংগঠিত হত্যা ও অন্যান্য অপরাধের জন্য দায়ীদের দায়মুক্তি দেয়ার পাশাপাশি ঢাকায় আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের সামনে নিরস্ত্র ‘বিশ্বাসঘাতক’দের বেয়নেট দিয়ে হত্যাকারী কাদের সিদ্দিকীকেও দায়মুক্তি দেয়। ৫ জন উর্দূভাষীকে কোনো ধরনের নিয়মতান্ত্রিক বিচার ছাড়াই প্রকাশ্য হত্যার এ ঘটনাটি ঘটে ঢাকা স্টেডিয়াম এলাকায় ১৮ ডিসেম্বর বিকাল চারটায়। সেদিন সেখানে একটি মুক্তিযোদ্ধা সমাবেশের আয়োজন করা হয়েছিল। (দেখুন, আহমেদ ইলিয়াস, বিহারি: বাংলাদেশে ভারতীয় অভিবাসী, পৃ. ১৯১)।…

একাত্তরে এবং বাহাত্তরে বাংলাদেশে উর্দুভাষীদের ওপর নিপীড়নের সবচেয়ে বিস্তারিত তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরেছেন খ্যাতনামা সাংবাদিক কুতুবুদ্দিন আজিজ তার ‘Blood and Tears’ শীর্ষক গ্রন্থে। (গ্রন্থটির মূল ইংরেজি সংস্করণ প্রকাশিত হয় ১৯৭৪ সালে) উর্দুভাষী যুদ্ধ-উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনে করাচিতে দায়িত্বপূর্ণ পদে যুক্ত ছিলেন তিনি। সেই সূত্রে ১৭০ জন প্রত্যক্ষদর্শীর সঙ্গে নিবিড় আলাপচারিতা শেষে ৩৩ অধ্যায় জুড়ে স্থান-কাল-পাত্রসহ শত শত হামলার বিবরণ তুলে ধরে কুতুবউদ্দিন দাবি করেছেন, দু’ দফায় (২৫ মার্চের আগে এবং ১৬ ডিসেম্বরের পরে) বাংলাদেশের অন্তত ১১০টি শহরে হাজারে হাজারে উউর্দুভাষী পদ্ধতিগতভাবে হত্যা, ধর্ষণ ও লুষ্ঠনের মুখোমুখি হন। তবে তিনি প্রত্যক্ষদশীদের বরাতে এও উল্লেখ করতে ভোলেননি, স্থানীয় অনেক বাঙালি ঝুঁকি নিয়ে ভীত বিহ্বল অবাঙালিদের আশ্রয়ও দিয়েছিল।

বাংলাদেশে রাজনৈতিক খুন তথা বিচারবহির্ভূত হত্যার সংস্কৃতির উপরোক্ত যাত্রাবিন্দুকে স্থানীয় ইতিহাসবেত্তারা বরাবর এড়িয়ে যান। জাতীয় পর্যায়ে ইতিহাসের ঐ লগ্নে প্রায় সকল প্রধান প্রধান দল “সমাজতন্ত্র”-এর জন্য উচ্চকণ্ঠ থাকলেও বেসামরিক নিরস্ত্র উর্দুভাষীদের (যাদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠই ছিল রেলওয়ে ও পাটকলগুলোর শ্রমজীবী ও নিম্নপদস্থ কর্মচারী এবং সৈয়দপুরসহ আরও কয়েকটি স্থানে যারা যুদ্ধ-পূর্ববর্তী সময়ে মুলত বামপন্থী ধারার ট্রেড : ইউনিয়নে সম্পৃক্ত ছিল) বিরুদ্ধে সৃষ্ট ঐ হত্যাযজ্ঞের সক্রিয় বিরোধিতা করেছে এমন দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় না। জিঘাংসার এই অধ্যায় এতই বর্ণবাদী চেতনায় আপ্লুত ছিল যে, মোহাম্মদ আলাউদ্দিন নামে যে উর্দু্ভাষী ব্যক্তিটি ঢাকার মোহাম্মদপুর ইউনিট আওয়ামী লীগের অন্যতম নেতা ছিলেন এবং মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস যাকে লুকিয়ে থাকতে হয়েছিল নিজ কমিউনিটির হাত থেকে বাঁচার জন্য তিনিও একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর ধানমন্ডিতে প্রকাশ্যে খুন হয়ে যান স্রেফ অবাঙালি হওয়ার কারণে। অথচ ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে সেদিন গিয়েছিলেন তিনি আওয়ামী লীগের অন্যান্যদের সঙ্গে বিজয় উদযাপনের জন্য।

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের পর প্রায় ১০-১২ হাজার উর্দুভাষীকে ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে অন্তরীণ করা হয়েছিল। এদের ঘিরে কীরূপ দুর্নীতি হয়েছে তার একটি বিবরণ পাওয়া যায় সেই সময়কার সুপরিচিত দৈনিক গণকষ্ঠে ১৯৭৪ সালের ৮ জুলাই, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার সংক্রান্ত এক লেখায়। কারাবাসী উর্দুভাষীদের অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে লেখা হয়েছে :

“…এসব বিহারির কাছ থেকে ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত (আটককালে পাওয়া) জমা নেয়া হয়। কোন কোন বিহারির কাছ থেকে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত পাওয়া গিয়েছিল।…তদন্তে দেখা যায়, যে জমা দিয়েছে ৫ হাজার টাকা তার নামের পাশে লেখা আছে ৫০ টাকা।..এমনও শোনা যায়, বিহারিরা থাকাকালীন টাকার বিনিময়ে রাতে মহিলা সেল খোলা থাকত।…”

উর্দুভাষীদের ভাগ্য বিপর্যয়ের সাথে তুলনা করলে যুদ্ধের সময় পশ্চিম পাকিস্তানে আটকে পড়া বাংলাদেশিদের সৌভাগ্যবানই বলতে হবে। কারণ ঐরূপ চার লাখ বাঙালি—যাদের মধ্যে প্রায় ২০ হাজার সেনা অফিসার ও জওয়ানও ছিলেন— তুলনামূলকভাবে অতি নগণ্য শারীরিক ক্ষয়ক্ষতি ও বস্তগত সম্পদ খুইয়ে নির্বিঘ্নেই বাংলাদেশে ফিরতে পেরেছিলেন। ১৯৭৩ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর আটকেপড়া বাংলাদেশিদের প্রথম দলটি ঢাকায় পৌঁছায়।

উল্লেখ্য, পাকিস্তান ও বাংলাদেশে আটকেপড়া সামরিক ও বেসামরিক ব্যক্তিরা যে চুক্তির বলে নিজ নিজ দেশে ফেরার সুযোগ পান তাতে বাংলাদেশ কোনো পক্ষই ছিল না। চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয় নয়াদিল্লিতে ১৯৭৩ সালের ২৮ আগস্ট। ভারতের পক্ষে পি এন হাঁকসার এবং পাকিস্তানের পক্ষে আজিজ আহমেদ এই চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এই চুক্তি স্বাক্ষর বিশেষভাবে সহজ হয় যখন বাংলাদেশ জানিয়ে দেয়, ভারতের হাতে আটক ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধী পাকিস্তানি সেনার বিচারের দাবি সে ছেড়ে দিচ্ছে।

তথ্যসূত্র:
(১) এ বিষয়ে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক উৎসের বিবরণের জন্য দেখুন: আহমেদ ইলিয়াস, বিহারি: বাংলাদেশে ভারতীয় অভিবাসী (ঢাকা: শামসুল হক ফাউন্ডেশান, ২০০৭) পৃ. ৯৭
(২) The Bangladesh National Liberation Struggle [Indemnity] Order, 1973. President’s Order No. 16 of 1973. Published in the Bangladesh Gazette, Extraordinary, Dated the 28 February 1973, Dhaka.

Share This
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp
Share on email
Related Articles
Recent Articles

রাফান আহমেদ-এর বইসমূহ

আলাদাবইওয়াফিলাইফ

Copyright © Rafan Ahmed

No part of the website or posts can be published elsewhere without prior permission from author.  

Copyright © 2021 All rights reserved

error: Content is protected !!