সাম্প্রতিক কালে একজন ফেসবুকার লিখেছেন, কেউ কেউ মনে করে ❝ ‘বানর থেকে মানুষ এসেছে’ এরকম একটি কথা না কি বিজ্ঞান বলেছে।❞ বিভিন্ন ওয়াজ-মাহফিল ও পত্রপত্রিকার রেফারেন্স দিয়ে তারা নাকি বলেছে, ❝ডারউইন নামের একজন নাস্তিক বিজ্ঞানী এটি বলেছেন।❞ ফেসবুকার এই ধারণাকে ভুল সাব্যস্ত করে লিখেছেন, ❝সত্য হলো, ‘বানর থেকে মানুষ এসেছে’ এটি ডারউইন বা বিজ্ঞানের কেউ বলেন নি। ডারউইনের তিনটি বইয়ের কোথাও আমি এমন কথা পাই নি। এটি রটিয়েছে কবিরাজেরা। কবিরাজেরা তাদের নিজেদের স্বার্থে, ধর্মপাগল মানুষদের লেলিয়ে দিয়েছে বিজ্ঞানের পেছনে।❞
মজার ব্যাপার হলো ডারউইনের কেতাব পড়ে ফেসবুকার কোন জিনিসটা পেয়েছেন তা কিন্তু উল্লেখ করেন নি। ঐ পোস্টের কমেন্টে এই বিষয়টা ইঙ্গিত করে একজন প্রশ্ন করেছেন, ❝ডারউইন প্রস্তাব করেছে মানুষ আর শিম্পাঞ্জি আসলে একটি জীব থেকে এসেছে। যেটাকে সাধারণ পূর্বপুরুষ বা কমন অ্যানসেস্টর বলে। এই জীব থেকে বিবর্তনের ফলে মানুষ (হোমো গণ) আর শিম্পানি (পানিন গণ) আলাদা হয়ে গেছে। তাহলে প্রশ্ন হলো মানুষ আর শিম্পাঞ্জি যে সাধারণ পূর্বপুরুষ থেকে এসেছে সেটা দেখতে কার সাথে মিলে? সেই জীবটা কেমন দেখতে?❞
পোস্টদাতা ভদ্রলোক এর উত্তর দেন নি। চলুন আমরা উত্তর খুঁজে আসি। ডারউইনের কাছেই আগে যাই। ফেসবুকার সাহেব বলেছেন ডারউইনের ডিসেন্ট অব ম্যান পুরো পড়েও এমন কোনো কথা তিনি পাননি। আমরাও একটু পড়ি চলুন, বাংলা অনুবাদ থেকে উল্লেখ করছি:
জীবিকা নির্বাহের ধারা পরিবর্তনের ফলে বা পারস্পরিক অবস্থার পরিবর্তনের দরুন উচ্চশ্রেনীর বন-মানুষদের পূর্ব পুরুষেরা যেদিন গাছ থেকে নেমে এল, সেদিন থেকেই তাদের বিকাশের স্বাভাবিক ধারাও বদলাতে শুরু করল এবং তার ফলে তারা আরও নিদিষ্টভাবে চতুস্পদ বা দ্বিপদ হয়ে উঠল। (পৃ. ৭৩) … সামাজিক জীব হয়ে ওঠার জন্য আদিম মানুষকে অথবা তার বানর-সদৃশ্য পূর্ব পুরুষকে সেই সহজাত অনুভূতি অবশ্যই অর্জন করতে হয়েছিল যে অনুভূতির কারণে অনন্য জীবজন্তুরা দলবদ্ধ ভাবে বসবাস করে। (পৃ. ১৬২) … বানর সদৃশ্য জীব থেকে ধীরে ধীরে উন্নত হতে হতে ঠিক কখন সে এমন অবস্থায় পৌছল যখন থেকে তাকে মানুষ নামে অভিহিত করা যাবে তা বলা নিতান্তই অসম্ভব। তবে এ আলোচনা এখানে খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ নয়।মানব জাতীকে Race বলা হবে নাকি তাদের প্রজাতি বা উপ প্রজাতি নামে অভিহিত করা হবে তাতে কিছু যায় আসেনা। … (পৃ. ২১৮)
চার্লস ডারউইন, ডিসেন্ট অফ ম্যান, খন্ড ০১ (কলকাতা: দ্বীপায়ন, অনুবাদ: অসীম চট্টোপাধ্যায়, সঞ্জীব মণ্ডল/অসিত চৌধুরি
ফেইসবুকার সাহেব ডারউইনের তিনটি বই পড়ে তেমন কিছু পাননি বলে জানালেন। আমি স্রেফ ডারউইনের ডিসেন্ট অফ ম্যান বইতে এই অংশ পেলাম। এখন প্রশ্ন আসে ফেসবুকার সাহেব আদতে কখনো কী বইটা পড়েছেন? নাকি স্মৃতিদৌর্বল্য রোগে ভুগছেন?
এতো গেল সেকালে কথা, একালে কী অবস্থা? মানব বিবর্তন বিশেষজ্ঞদের অধিকাংশের মতে মানুষ আর শিম্পাঞ্জির কমন অ্যানসেস্টর বা সাধারণ পূর্বপুরুষ দেখতে কেমন? এর উত্তর আমরা পাবো নামকরা প্যালিও-অ্যান্থ্রোপলজিস্ট অধ্যাপক বার্নার্ড উড-এর বই থেকে; যাকে হিউম্যান অরিজিন এর উপর একজন অথরিটি হিসেবে ধরা হয়। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত Human Evolution: A Very Short Introduction (২য় সংস্করণ, ২০১৯) বইতে তিনি উল্লেখ করেছেনঃ
❝[T]he Pan/Homo common ancestor was neither like a living chimpanzee/bonobo nor like a modern human, most researchers agree that it was probably more like the former (i.e. chimpanzee) than the latter… Therefore, the common ancestor of chimpanzees and bonobos and modern humans was probably more like a living panin than a modern human. Its skeleton would most likely show evidence of being adapted for life in the trees. For example, its fingers would have been curved to enable it to grasp branches, and its limbs would have been adapted to walk both on all fours, and on the hind limbs alone. Its face would have been snout-like, not flat like that of modern humans, and its elongated jaws would have had relatively modest-sized chewing teeth, prominent canines, and large incisor teeth❞
অর্থাৎ অধিকাংশ বিবর্তন গবেষকের মতে মানুষ ও শিম্পাঞ্জির সাধারণ পূর্বপুরুষ খুব সম্ভব শিম্পাঞ্জির মত দেখতে ছিল। শিম্পাঞ্জি ও বুনোবো যে বানর উপগোত্রের অন্তর্গত সেটাকে প্যান/পানিন বলে। ড. বার্নার্ড উডসহ অধিকাংশ মানব-বিবর্তন গবেষক মনে করেন মানুষ ও শিম্পাঞ্জির সাধারণ পূর্বপুরুষ আজকের যুগের জীবিত বানর প্রজাতির সাথে মিলার সম্ভাবনা বেশি। অর্থাৎ যারা গাছে চড়ে অভ্যস্ত, আঙ্গুলগুলো গাছের ডাল ধরার জন্য বাঁকানো, চার পায়ে হাঁটে, পেছনের পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াতে পারে, মুখমণ্ডল চোখা, চোয়াল সামনে বাড়ানো—মানে মানুষের মত না আরকি। পাঠক বুঝতেই পারছেন এসব বৈশিষ্ট্য বানরের সাথেই মিলে। অধিকাংশ মানব বিবর্তন গবেষক মনে করেন মানুষ খুব সম্ভব বানরের মতই কোনো-না-কোনো প্রাণি থেকে এসেছে। সুতরাং ফেসবুকারের আবেগী কথা আমলে নিলে মানব বিবর্তনের অধিকাংশ গবেষকই কবিরাজ হয়ে যায়! কারণ তিনি রায় দিয়ে ফেলেছেন, ❝বানর থেকে মানুষ এসেছে এটি ডারউইন বা বিজ্ঞানের কেউ বলেন নি… এটি রটিয়েছে কবিরাজেরা❞! সরাসরি বানর থেকে মানুষ এসেছে বলা আর শিম্পাজি ও মানুষের পূর্বপুরুষ আজকের জীবিত বানরের মত দেখতে এমন বলার মাঝে তফাত লাউ আর কদুর মতন কী? পাঠকই বিচার করুন না হয়।
আরো পড়ুনঃ
– ডারউইনবাদ ভুল হলে কী সকল জীববিজ্ঞান পুরোটাই ভুল হবে?
– বিজ্ঞান ও নাস্তিকতা অ্যাকাডেমিক দৃষ্টিতে
তবে আমার মতে ভদ্রলোকের পোস্ট এই বানর-থেকে-এসেছে এই ধারণা খণ্ডনের জন্য বেশি লাইক-শেয়ার পায় নি। ডারউইন বলে নি বানর-থেকে-মানুষ-এসেছে এটা অনেকেই জানে, যারা তার পোস্টে লাইক দিয়েছেন তাদের অধিকাংশই জানেন। পোস্টে লাইক বেশি পাওয়ার গুরুত্বপূর্ণ কারণ সম্ভবত কতিপয় ধর্মপন্থি মানুষকে উদাহরণ হিসেবে এনে গণমানুষকে বিমানবিকরণ করার প্রচেষ্টায়। তিনি আক্রোশের সাথে লিখেছেন, ❝কবিরাজেরা তাদের নিজেদের স্বার্থে, ধর্মপাগল মানুষদের লেলিয়ে দিয়েছে বিজ্ঞানের পেছনে। ডারউইনের কোনো বই এ কবিরাজদের পক্ষে পড়া সম্ভব নয়। তারা পড়েছে তাদের আকৃতির পত্রিকা, তারা শুনেছে তাদের আকৃতির রটনা, আর মগজ ধুইয়েছে কোটি কোটি তরুণ ও বৃদ্ধের। এ অঞ্চলে মগজের ময়লা এতো দূর থেকে দেখা যায় যে, তা ধুইয়ে দিতে কাছে আসার প্রয়োজন নেই। দূর থেকে থুথু ছিটিয়ে দিয়েই এ মগজ ধুইয়ে দেয়া সম্ভব। ❞
ভদ্রলোক বুঝাতে চাচ্ছেন বিজ্ঞানকে ধর্মের শত্রু বানানোর পায়তারা করছে আসলে অন্ধধার্মিক কবিরাজেরা, নিজের স্বার্থে। কিন্তু নির্মোহ দৃষ্টিতে ইতিহাস ঘাটলে আমরা দেখতে পাই, বিজ্ঞানকে ধর্মের শত্রু বানানোর পুরো ন্যারেটিভটাই দাঁড় করানোর সূচনা করেছিল ভিক্টোরিয়ান ইউরোপে দুইজন কাঠসেকুলার লেখক—জন উইলিয়াম ড্রেপার ও অ্যান্ডু ডিকসন হোয়াইট। তারা রাজনৈতিক স্বার্থে ইতিহাসের অতি সরলীকৃত ও প্রপঞ্চময় উপস্থাপন করে একটি “ওয়ারফেয়ার থিসিস” পপুলারাইজ করে তোলেন। হাল আমলে যে থিসিসের অন্যতম বিক্রেতা হলো নব্য-নাস্তিক মহল, আর তাদের বঙ্গিয় মনদাস মুক্তমনা গোষ্ঠী। অথচ বিজ্ঞানের ইতিহাসের অ্যাকাডেমিকরা এই সংঘর্ষের বয়ান বহু আগেই প্রত্যাখ্যান করেছেন। এই ফিল্ডের একজন নামকরা অ্যাকাডেমিক ড. লরেনস এম. প্রিন্সাইপ তার কোর্সবুকে লিখেছেন (Science and Religion; p. 7, The Teaching Company, 2006):
“বিজ্ঞান বা বিজ্ঞান-ধর্ম বিষয়ক কোনো চিন্তাশীল ঐতিহাসিক এখন আর ওয়ারফেয়ার থিসিসকে সঠিক মনে করেন না। … এই ওয়ারফেয়ার থিসিসের জন্ম হয় ঊনবিংশ শতকের শেষের দিকে, বিশেষ করে দুজন মানুষের হাত ধরে – জন উইলিয়াম ড্রেইপার ও অ্যান্ড্রুডিকসন হোয়াইট। এই থিসিস উপস্থাপনের পিছনে এদের বিশেষ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল। এবং বলাই বাহুল্য তাঁদের কাজের ঐতিহাসিক ভিত্তি অনির্ভরযোগ্য।”
তাহলে কি ফেসবুকার ভদ্রলোক এখন নিরপেক্ষ হয়ে বলবেন, বিজ্ঞানকে ধর্মের শত্রু বানানোর বয়ান আসলে দুইজন সেকুলার কবিরাজ শুরু করেছিল, সেকুলারিজমের স্বার্থে। এই সেকুলার কবিরাজরা ❝পড়েছে তাদের আকৃতির পত্রিকা, তারা শুনেছে তাদের আকৃতির রটনা, আর মগজ ধুইয়েছে কোটি কোটি তরুণ ও বৃদ্ধের। এ অঞ্চলে মগজের ময়লা এতো দূর থেকে দেখা যায় যে, তা ধুইয়ে দিতে কাছে আসার প্রয়োজন নেই। দূর থেকে থুথু ছিটিয়ে দিয়েই এ মগজ ধুইয়ে দেয়া সম্ভব❞? তাদের এই আকাজ মুক্তমনা ও সুশীলরা সমাজে ছড়িয়ে ধর্মপন্থিদের বিজ্ঞানবিরোধী করে তুলেছে। তাই আজ যে প্রতিক্রিয়া আমরা দেখি তা মূলত সেকুলারদের জ্ঞানগত আগ্রাসনের ফল—এমন কথা উনি বলবেন কী? এই নিরপেক্ষ অবস্থানে গেলে সুশীল সমাজ থেকে লাইক শেয়ার বাহবা আসবে? আমার মনে হয় না। উলটো ছুপা ইসলামিস্ট ট্যাগ খেয়ে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা। এক এক্স-শাহবাগি ভাইকে বলতে শুনেছিলাম, কোনো-না-কোনো ভাবে ধার্মিক বিশেষ করে মুসলিমদের গালি দিয়ে, বিমানবিকরণ করে সুশীলরা অর্গাজমের স্বাদ পায়। এটা ছাড়া ওরা কোনো আলোচনা করতে পারে না। আমি এর সত্যাসত্য জানি না, তবে গণমানুষকে গালি দেয়া ছাড়া, বিমানবিকরণ করা ছাড়া যে সুশীল হওয়া যায় না এই কথাটা খুব সম্ভব ভুল না। আমি পোস্টদাতার ব্যাপারে এটা বলছি না, ইন জেনারেল পর্যবেক্ষণ থেকে বলছি।
কেন তথাকথিত কবিরাজরা বিজ্ঞানকে শত্রু বানাচ্ছেন তার কারণ খুঁজে বের করেছেন ফেসবুকার সাহেব। তার মতে, কবিরাজদের ❝বিজ্ঞানভীতির প্রধান কারণ— বিজ্ঞান মানুষকে প্রশ্ন করতে শেখায়। গামছার আড়ালের সত্যটুকো যেন মানুষ দেখে না ফেলে, এ জন্যই তাদের এ আয়োজন।❞ তার কথাটা আমি পুরোপুরি সঠিক মনে করি না। শুধু বিজ্ঞান নয় আরো অনেক কিছু প্রশ্ন করতে শেখায়। ধর্ম-দর্শন শিল্প-সাহিত্য, নন্দনতত্ত্ব ইত্যাদি জ্ঞানের প্রতিটা শাখায়ই নানাভাবে নানাদিকে নানা আঙ্গিকে বিভিন্ন বিষয়ে প্রশ্ন করে। সুতরাং শুধু বিজ্ঞানই মানুষকে প্রশ্ন করতে শেখায় এই ধরনের মানসিকতা এক অর্থে জ্ঞানের অন্যান্য শাখা কে খর্ব করার মানসিকতা নিয়ে পপুলার ন্যারেটিভে দাঁড় করানো হয়েছে। বিজ্ঞানের ইতিহাস বিষয়ে যারা জানেন তারা কিন্তু সহজেই বুঝতে পারবেন এই যে মানসিকতা এটা এক ধরনের বিজ্ঞানবাদি চেতনাপ্রসূত যেখানে বিজ্ঞানকেই জ্ঞানের একমাত্র বা সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য মানদণ্ড ভাবা হয়, বাদবাকি হচ্ছে দ্বিতীয় শ্রেণীর জ্ঞান। অগাস্ট কোঁৎ এর থ্রি স্টেজেস অফ নলেজ ধারণা, ভিয়েনা সার্কেলের পজিটিভিজম প্রবর্তন নিয়ে যারা জানেন তারা বুঝতে পারবেন।
এবার টেবিলটা উলটে দিয়ে আমি বিনয়ের সাথে ফেসবুকার ভাইকে প্রশ্ন করতে চাই, তার মনে বিজ্ঞান কবিরাজরা ভয় পায় কারণ বিজ্ঞান প্রশ্ন করতে শেখায়-এই অভিযোগটা কি স্বয়ং কখনো কখনো বিজ্ঞানীদের উপরও আসে? বিশেষ করে বিবর্তন নিয়ে? হ্যাঁ আসে এবং এর দলিলও রয়েছে। সেকুলার বিবর্তনবাদী লেখক রিচার্ড হালভোরসান এ বিষয়ে আলোচনা করেছেন হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা অনলাইন ম্যাগাজিন হার্ভার্ড ক্রিমসনে। উনি অ্যাকাডেমিয়ার একটা অজানা বাস্তবতা তুলে এনেছেন। তার মুখ থেকেই শোনা যাকঃ
“বিবর্তন ব্যাখ্যায় নব্য-ডারউইনবাদ কিংবা পাংচুয়েটেড ইকুইলিব্রিয়ার মতো সূক্ষ্ম ব্যাপারস্যাপার শিখতে আমাদের উৎসাহ দেয়া হয় বটে। কিন্তু ডারউইনিয় ধ্যানধারণা যে তাবৎ দুনিয়ার সবকিছুর ব্যাখ্যা দিতে পারে – এই ধারণাকে প্রশ্ন করলেই বুদ্ধিজীবী মহল থেকে আপনাকে সমাজচ্যুত করা হবে।… বিবর্তনবিদেরা নানাবিধ পরীক্ষানিরীক্ষার সাহায্যে ডারউইনের প্রস্তাবনাকে যাচাইয়ের চেষ্টা করেন বটে; কিন্তু সেই হাইপোথিসিসের মৌলিক ভিত্তিগুলোকে এতই পবিত্র ভাবা হয় যে—‘ধরা যাবে না ছোঁয়া যাবে না বলা যাবে না কথা’! অথচ অন্যসবকিছু নিয়ে আমাদের অনর্থক সংশয়প্রবণতার শেষ নেই।… কোনটা স্রেফ সংশয় আর কোনটা প্রাতিষ্ঠানিক গোড়ামি, সেটা বুঝতে ডক্টরেট করা লাগে না। এই যেমন ন্যাশনাল সেন্টার ফর সাইন্স এডূকেশনের স্কিপ ইভান্স এর চিন্তা ছিল যে ক্লাসে যদি বিবর্তনের বিপক্ষের যুক্তি-প্রমাণ গুলো আলোচনা করা হয়, তাহলে তা কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মনে “সংশয়ের বীজ” বুনতে পারে। … (অধ্যাপকেরাও অনেক সময় ডারউইনবাদিদের আগ্রাসন থেকে রেহাই পান না।) তাদের প্রায়ই একঘরে করে ফেলা হয় কিংবা পদাবনতির সম্মুখীন হতে হয়। এমনকি কখনো কখনো তাদের পদচ্যুত করা হয়। বেইলর ইউনিভার্সিটির এক অধ্যাপকের গবেষণার জন্য বরাদ্দ তহবিল বাতিল করা হয়েছিল—যখন কর্তৃপক্ষ জানতে পারে তার গবেষণার দ্বারা বিবর্তনের পূর্বানুমানগুলোর ভিত নড়ে যাবে। তাই দেখা যায়, অনেক বিবর্তন নিয়ে সন্দিহান অনেক অধ্যাপক ছদ্মনাম ব্যবহার করেন। কারণ বিবর্তনের বিপক্ষের যুক্তি-প্রমাণ নিয়ে প্রকাশ্যে কিছু লিখলে তাদের চাকরী চলে যেতে পারে বা ক্যারিয়ারের ক্ষতি হতে পারে।”
কি অদ্ভুত ব্যাপার!! ফেসবুকে সাহেব বললেন কবিরাজরা শুধু বিজ্ঞানের প্রশ্নকে ভয় পায় এখন দেখছি বিবর্তনভক্তরাও অনেক সময় বিজ্ঞানের প্রশ্নকে ভয় পায়!
শুধু কি তাই মনোবিজ্ঞানের ফিল্ডে দেখুন না। বিগত বেশ কয়েক বছর ধরে এমন সব পর্যবেক্ষণযোগ্য প্রমাণ মিলছে যার দ্বারা বিজ্ঞানীদের মাঝে বহুল প্রচলিত দার্শনিক বিশ্বাস ‘মনই-হলো-মগজ, মনের কোনো আলাদা অস্তিত্ব নেই’ আর টিকছে না। অথচ যারা এই বিষয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্র প্রকাশ করতে যাচ্ছে হয় তাদের গবেষণাপত্র প্রকাশ করতে দেওয়া হচ্ছে না অথবা প্রকাশ করার পর যখন জার্নাল কর্তৃপক্ষ বুঝতে পেরেছে তারা ‘বিশ্বাস বহির্ভূত’ কাজ করেছে তখন সেই পেপারটাকে কোন রকম কারণ দর্শানো ছাড়াই প্রত্যাহার করে নেওয়া হচ্ছে! এ ব্যাপারে মনোবিজ্ঞানী ড. বেথানি বাযারের অভিজ্ঞতা পড়তে পারেন এই লিংকে।
স্বভাবতই প্রশ্ন আসে কেন এত ভয় পাচ্ছেন তারা? যদি পর্যবেক্ষণযোগ্য প্রমাণ আমাদেরকে বলে মন-সমান-মগজ নয় তাহলে কী হারাবেন তারা? বিজ্ঞানে না বিশ্বাসে কোনো স্থান নেই?! কেউ যদি এসব শুনে এখন ফেসবুকার সাহেবের শব্দ ব্যবহার করে বলে ফেলে, “বৈজ্ঞানিকভাবে চিন্তা করা বেশ পরিশ্রমের কাজ, এবং এ কাজে দরকার পড়ে পড়াশোনোর। এজন্য তারা, নিজেদের হীনমন্যতাকে ঢাকতে গামছা ছুঁড়ে দিয়েছে বিজ্ঞানের গায়ে। মুশকিল হলো, এ গামছা একটু ফুঁ দিলেই উড়ে যাচ্ছে” তাহলে কি খুব বড় কোনো অপরাধ হয়ে যাবে?
লেখা অনেক বড় হয়ে গেল। আরো অনেক কিছু বলার ছিল। বিশেষ করে বিজ্ঞানকে ভদ্রলোক যেভাবে চিত্রিত করেছেন তাতে বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির মাঝে ফারাক বজায় রাখতে পারেন নি বলে আমার মনে হয়েছে। অথচ এই ফারাক বজায় না রাখার অপরাধে একজন কবিকে তিনি গঠনমূলক সমালোচনা করে লম্বা পোস্ট দিয়েছিলেন। বেশ গুছানো আলোচনা করেছেন তাতে।
আমার কথায় কেউ কষ্ট পেলে দুঃখিত। কারো নাম নিলাম না। কাউকে বড় বা ছোট করার ইচ্ছা নাই, কারো বিরুদ্ধবাদি হিসেবেও দাঁড়াতে চাই না। এমনিতেও আমার পিছে উন্মুখ হয়ে লেগে থাকা মানুষের অভাব নেই। সবার জন্য শুভকামনা।
আলোচনায় অবিশ্বাসী কাঠগড়ায় এবং হোমো স্যাপিয়েনসঃ রিটেলিং আওয়ার স্টোরি বই এর সাহায্য নেয়া হয়েছে। আফতাব আহমদ ভাইয়ের প্রতি বিশেষ কৃতজ্ঞতা ডিসেন্ট অফ ম্যান বই থেকে প্রয়োজনীয় অংশ ছবি তুলে পাঠানোর জন্য। ফিচার ছবি: দ্য ইকোনমিস্ট