[ড. মুনতাসীর মামুন, বাংলাদেশি ইতিহাসবিদ ও সাহিত্যিক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ছিলেন। ঢাকা শহরের অতীত ইতিহাস নিয়ে তিনি গবেষণা করে থাকেন। তিনি দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক দর্শনে বিশ্বাসী। তিনি ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির প্রতিষ্ঠাতা এবং বাঙালি জাতিবাদীদের ফ্যাসিবাদী আন্দোলন শাহবাগ আন্দোলনের অন্যতম তাত্ত্বিক ও কর্মী। তার বাঙালি জাতিবাদী পরিচয়টা খুব গুরুত্বপূর্ণ। ইতিহাস ঘেঁটে এবং বাস্তবেও দেখা যায় বাঙালি জাতিবাদ মূলত বর্ণ*ন্দুর সংস্কৃতিকে কেন্দ্র করে তৈরি করা জাতি পরিচয় নির্মান করে। এই প্রকল্পের বুনিয়াদি ‘অপর’ হলো মুসলমান ও তার সংস্কৃতি। লেখক নিজেই এই জাতিবাদের রাম-লাঠিয়াল। তার মুখে কোরবানীর অধিকার আদায়ের এই সংগ্রামের কথা শোনা গুরুত্ব রাখে। বলা যায় বাধ্য হয়েই তাকে এসব স্বীকার করতে হয়েছে। ইতিহাসের এই বাস্তবতা মুছা যায় নি। যদিও ইতিহাসের বাস্তবতা মুছা ও বদলানোর কাজ তারা খুব আন্তরিকতার সাথে করে থাকে।]
ঈদ-উল আজহা আমাদের এখানে কোরবানীর ঈদ এবং বিশেষ করে বকরী ঈদ নামেই বেশি পরিচিত। কোরবানীর ঈদ না হয় বোঝা গেল, কিন্তু বকরী ঈদ? অনেকের ধারণা সুরা বাকারা থেকে ‘বকরী’ শব্দটি চালু হয়েছে। বাকারা সূরার গাভী সম্পর্কে বলা হয়েছে, কিন্তু তা অন্য প্রসঙ্গে। ঈদের সঙ্গে এর কোন সম্পর্ক নেই। তাছাড়া বকরী মানে আমরা নির্দিষ্টভাবে একটি পশু-ছাগল (খাসী)কেই বুঝি।
ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয় এর কারণ অন্য। একশো বা দেড়শো বছর আগে বাংলাদেশে গরু কোরবানী দেয়া প্রায় অসম্ভব ছিল। বিশেষ করে হিন্দু জমিদারের অঞ্চলে যেখানে গরু কোরবানী সম্পর্কে তারা বৈরি মনোভাব পোষণ করতেন। কোরবানী যদি কেউ দিতেন তা হলে খাসী বা ছাগলই দিতেন। ‘বকারা’ মানে গাভী। আরবী এই শব্দটির বিকৃত রূপ হয়েছে ‘বকরী’। কিন্তু গরু যেহেতু কোরবানী দেওয়া সম্ভব নয়, কোরবানী দেওয়া হচ্ছে ছাগল, তাই বকরী মানে দাড়িয়ে গেল ছাগল। আবুল মনসুর আহমদের আত্মজীবনীতে এর ইঙ্গিত মেলে! প্রায় একশো বছর আগের ঈদ-উল আজহা সম্পর্কে তিনি লিখেছিলেন- “বকরা ঈদে গরু কোরবানী কেউ করিত না। জমিদারদের তরফ হইতে ইহা কড়াকড়িভাবে নিষিদ্ধ ছিল। খালি বকরী কোরবানী করা চলিত। লোকেরা করিতও তা প্রচুর।” …
আজকে আমরা ঈদ-উল আজহায় অনায়াসে গরু [বা অন্য কিছু]! কিনে এনে সহজেই কোরবানী দিয়ে ফেলি, আশি একশো দূরে থাকুক পঞ্চাশ বছর আগেও তা তেমন সহজসাধ্য ছিল না। আজকের প্রজন্ম হয়ত অবাক হবে যে, এ নিয়ে সুদীর্ঘ পঞ্চাশ বছর বিতর্ক চলেছে। এবং কোরবানী বিশেষ করে গরু কোরবানী দেওয়ার অধিকার আমাদের বাপ দাদাদের লড়াই করে আদায় করতে হয়েছিল।
কিন্তু কেন এ বিতর্ক হয়েছিল? হিন্দুদের [অনেক ক্ষেত্রে মুসলমানদেরও] সংস্কার ছিল গরুর মাংস না খাওয়া। তারা ছিল সমাজে প্রাধান্য বিস্তারকারী শ্রেণী। ফলে তারা গরু জবাই-এর ছিল বিপক্ষে৷ বিশেষ করে যে এলাকা ছিল হিন্দু জমিদারের অধীনে, সে এলাকার কথা সহজেই অনুমেয়৷ অন্যদিকে গত শতকের শেষের দিকে মুসলমানরা বিশেষ করে যাঁদের খানিকটা বিত্ত আছে, ধর্ম কর্ম নিয়ে মাথা ঘামাতে শুরু করেছিলেন, তাঁরা ধর্মীয় বিধান মানার জন্য কোরবানী বিশেষ করে গরু কোরবানী করতে চাইলেন। এটা তাঁরা দেখেছিলেন, সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্মীয় অধিকার হিসেবে। এর সঙ্গে সম্প্রদায়গত মান-অপমানের ব্যাপারটিও ছিল যুক্ত, ফলে পুরো বিষয়টি নিয়ে তুমুল বিতর্ক শুরু হয়েছিল এবং তা শুধু বাংলায় সীমাবদ্ধ থাকেনি, ছড়িয়ে পড়েছিল সারা ভারতে ৷ পঞ্চাশ বছরের এ বিতর্কের বিভিন্ন বিবরণ ছড়িয়ে আছে সমসাময়িক পত্র-পত্রিকা পুস্তিকায়। এসব পড়লে, একটি বিশেষ সময়ের বিশেষ সমাজের এলিটদের চিন্তা-ভাবনা, সমাজ, রাজনীতি সম্পর্কে ধারণা করা যেতে পারে, যা সামাজিক ইতিহাসের জন্য গুরুত্বপূর্ণ৷
ধরে নিতে পারি, ১৮৮২ সালে দয়ানন্দ সরস্বতী “গো হত্যা নিবারণী” সভা স্থাপন করলে শুরু হয়েছিল বিতর্ক ৷ ‘গো-হত্যা’ বা ‘গরু’ কোরবানীর বিপক্ষে এ সভা থেকে ভারত জুড়ে চালানো হয়েছিল প্রবল প্রচার। ১৮৮৭ সালে রাজশাহীর তাহিরপুরের জমিদার শশিশেখর রায় কংগ্রেসের মাদ্রাজ অধিবেশনে এ পরিপ্রেক্ষিতে উত্থাপন করেছিলেন প্রস্তাব৷ ফরিদপুর ও বিভিন্ন অঞ্চলেও এ নিয়ে প্রচার শুরু হয়েছিল। তখন এর বিরোধিতা করতে মুসলমানদের বিভিন্ন সভা বা আঞ্জুমানসমূহ এগিয়ে এসেছিল। বিত্তবান হিন্দুদের এ প্রচারণার সমর্থনে এগিয়ে এসেছিলেন স্থানীয় হিন্দু জমিদাররা৷ ঐ সময়কার অবস্থার একটি বিবরণ পাওয়া যাবে ইবনে মাযুদ্দিন আহমদের আত্মজীবনী ‘আমার সংসার জীবন’-এ। তিনি লিখেছিলেন- “…গোবিন্দপুর হরিশঙ্করপুর, সনাতন, গোপীনগর, আমলা গোসাঞী পুকুর প্রভৃতি কতকগুলি গ্রাম একজন প্রচণ্ড প্রতাপান্থিত বড় হিন্দু জমিদারের জমিদারীভুক্ত; সেখানকার মুসলমানগণ বহুকাল অবধি গরু কোরবানী করিতে বা গরু জবেহ ও উহার মাংস ভক্ষণ করিতে পারিত না। কেহ করিলে তার আর রক্ষা ছিল না। জমিদার কাছারীর দুর্দান্ত হিন্দু নায়েবগণ কোরবানীদাতা ও গরু হত্যাকারীকে ধরিয়া আনিয়া প্রহার ও নানা অপমান করিত এবং তাহাদের নিকট জরিমানা আদায় করিত। সুতরাং তাহাদের অত্যাচারে ঐ অঞ্চল হইতে গো কোরবানী প্রথা উঠিয়া গিয়াছিল।” মাযুদ্দিন জানিয়েছেন-মভা সমিতি আন্দোলন করে তাঁরা খানিকটা সুবিধা আদায় করেছিলেন তা হল সাবধানে ও গোপনে গরু কোরবানী করা।
১৮৯৫-এর দিকে জানা যায়, ময়মনসিংহের অশ্বরিয়া, মুক্তাগাছা ও সন্তোষের জমিদার ঈদ-উল আজহায় গরু কোরবানীর জন্য বেশ কিছু মুসলমানকে জরিমানা করেছিলেন। ১৯০৫ সালে চাঁদপুরে কয়েকজন কোরবানী উপলক্ষে গরু কোরবানী দিয়েছিল। এর ফলে, জনৈক গোপাল চন্দ্র মজুমদার তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছিলেন ৷ অভিযোগ ছিল মুসলমানরা প্রকাশ্যে রাস্তায় গরু জবেহ করেছে” এবং ‘বদ্ধজলে’ মাংস ধুয়ে জল অপবিত্র করেছে। জেলা হাকিম ছিলেন জগদীশচন্দ্র সেন৷ তিনি তিনজন মুসলমানকে অভিযুক্ত করে একজনকে এক মাসের জেল এবং অপর দু’জনকে যথাক্রমে পঞ্চাশ ও পনের টাকা জরিমানা করেছিলেন। …
এ শতকেও দেখছি গরু কোরবানী নিয়ে উত্তেজনা ত্রাস পায়নি। ১৯১০ সালের সংবাদে জানা যাচ্ছে, বাংলাদেশে গরু কোরবানীতে বাধা দিচ্ছেন স্থানীয় হিন্দু জমিদাররা ৷ ‘বাসনা’ লিখেছিল-“অনেক জমিদার মহাশয় কলকাতা গ্রেট ইস্টার্ন হোটেলে কাবাব খাইতে পারে কিন্তু আপন জমিদারী মধ্যে মুসলমান প্রজাদিগকে তাহাদিগের ধর্ম্মকার্য্য (কোরবানী) করিতে দেন না। এই শ্রেণীর জমিদার মহাশয়গণ যতদিন তাহাদিগের অস্তঃকরণ প্রশস্ত না করিয়া মুসলমান গরীব প্রজাদিগকে তাহাদিগের ধর্ম্মকার্য্য প্রকাশ্যভাবে করিতে অনুমতি না দিবেন, ততদিন ঐক্য স্থাপিত হইবে না।” ১৯১৭ সালে ‘আল-এসলাম’-এ হিন্দু মুসলমানের দ্বন্দ্বের যে চারটি কারণ উল্লেখ করা হয়েছিল তার মধ্যে একটি ছিল ‘গো কোরবানীতে বাধা প্রদান।’ এ পরিপ্রেক্ষিতে লেখা হয়েছিল-মুসলমান যখন ‘তাহাদের নিজের বাড়িতে “গো কোরবানী” কার্য্য সমাধান করেন, কোন সাধারণের গমনের প্রকাশ্য স্থানে করেন না, তখন ইহাতে হিন্দুর বাধা দিবার কোন কারণ হইতে পারে না। তবু মুসলমানদিগকেও বলি তোমরা প্রতিবেশীর প্রতি কর্তব্যের অনুরোধে সম্ভব ‘গো কোরবানী’ কার্য আড়ালে সম্পন্ন করিবে।’
১৯২৫ সালে এ প্রশ্ন তুলেছিলেন একটি পত্রিকায় জনৈক ‘রওশন হেদায়েৎ’- “মুসলমান কখনও হিন্দুর দুর্গা পূজায় বাধা দেয় না. কিন্তু মুসলমানদিগের গো কোরবানীতে হিন্দু প্রজাদের মাথা বিগড়ায় কেন?” ন্যায্য প্রশ্ন, কিন্তু পাকিস্তান হওয়ার আগে এর সম্তোষজনক মীমাংসা হয়নি৷ ১৯৩০ সালেও দেখি, আকরম খার প্রভাবশালী ‘মোহাম্মদী’তে কোরবানীর পক্ষে, ‘সঞ্জীবনী’(তে) বিপক্ষে লেখা হচ্ছে। তবে, হিন্দু মালিকানাধীন কিছু পত্র-পত্রিকায় গরু খাওয়া যে হিন্দুদের ধর্মবিরোধী নয়, বরং সংস্কার, এ বক্তব্য যুক্তি দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা হচ্ছিল।
১৯০১ সালে ‘মোহাম্মদী’তে ‘আলোচনা’ বিভাগে মওলানা আকরম খাঁ প্রথমে এ ধরনের একটি পত্রিকা থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছিলেন-“মুসলমানরা যেরূপ বকরী ঈদ উপলক্ষে গো-কোরবানী করেন, সত্য ত্রেতা দ্বাপর যুগের আর্যরাও ঠিক সেই ভাবে “গো-মেধ যজ্ঞ” পালন করিতেন ৷ বকর ঈদ আর “গো-মেধ যজ্ঞ” প্রায় সমর্থবাচক শব্দ। তবে কোন দোষযুক্ত গরু কোরবানী করা চলিবে না মুসলমানদের ধর্মশাস্ত্রের তাহার যেরূপ মছলা আছে, হিন্দু শাস্ত্রেও তাহার অনুরূপ ব্যবস্থা দেখিতে পাওয়া যায়।”
‘সঞ্জীবনী’ আবার এ নিয়ে কটাক্ষ করে লিখেছিল, “এঁসব প্রাচীন তত্ত্ব কেন প্রকাশ করা হইতেছে? হিন্দুকে গো মাংস ভক্ষণ করার জন্য? এদেশে গো-মাংস চলিবে না।”
এরপর লিখেছিলেন আকরম খাঁ-“এদেশের গো মাংস চলিবে না বলিয়া সহযোগী যে চরম মন্তব্য পেশ করিয়াছেন, অবস্থা গতিকে তাহার সমর্থন আমরা করিতে পারিতেছি না। কারণ, এখন এদেশে গো মাংস বেশ সচল হইয়া আছে। মুসলমান ও খৃষ্টানের কথা ছাড়িয়া দিলেও, হিন্দু জাতির বহু শাখা প্রশাখার মধ্যে আজও যথেষ্ট প্রচলন আছে। বকর ঈদের সময়- গো-মেধ যজ্ঞের প্রসাদ লাভের জন্য এই শ্রেণীর শত শত নর-নারী মুসলমান পড়ীগুলিতে ঘুরিয়া বেড়ায়। প্রধানত এই ‘গো-খাদক’ হিন্দুরাই আজ মহাত্মা গান্ধীর পরিভাষায় ‘হরিজন’ বিশেষণ লাভ করিয়াছে। উচ্চ স্তরের হিন্দুদিগের, এমনকি হিন্দু সভার নেতৃবর্গের মধ্যে গো-খাদক হিন্দুর যে একেবারেই অভাব কোন সত্যনিষ্ঠ হিন্দুই বোধ হয় একথা জোর করিয়া বলিতে পারিবেন না। সুতরাং এদেশে এখনই যখন গো মাংসের প্রসার এতটা বিদ্যমান আছে এবং উচ্চন্তরের শিক্ষিত হিন্দুরা যখন বেদাদি প্রকৃত হিন্দুশাস্ত্র ও প্রাচীন যুগের ব্যবহার হইতে গো কোরবানীর ও গো মাংস ভক্ষণের বৈধতা সপ্রমাণ করিতে এতটা আগ্রহ প্রকাশ করিতেছেন, তখন ‘এদেশে গো মাংস চলিবে না’-বলিয়া চরম ঘোষণা প্রচার করা সহযোগীর পক্ষে সঙ্গত হইয়াছে বলিয়া মনে হয় না।” …
জাহানারা ইমাম তার আত্মজীবনী ‘অন্য জীবন’-এ লিখেছেন-“গুরুত্বের দিক দিয়ে ঈদ-উল-ফিতরই সকলের উপরে অথচ আমার ছোটবেলার স্মৃতিতে রোজার ঈদ খুব বড় হয়ে ফুটে নেই। কারণটা বোধহয় রোজার ঈদে ঘটনার তেমন সমারোহ নেই, যেমনটি আছে কোরবানীর ঈদে।” ঘটনার সমারোহ মানে তিনদিন বরাদ্দ কোরবানীর জন্য৷ তা’ যারা কোরবানী দিতে পারতেন, তাদের জন্য আনন্দ একটু বেশি ছিল বৈকি। জাহানারা ইমামের পরিবার ছিলেন সম্পন্ন৷ কিন্তু, সে আমলে অধিকাংশ মুসলমানের পক্ষে, আমার মনে হয় কোরবানী দেয়া ছিল কষ্টকর৷ দারিদ্র্য হাড়াও উচ্চবর্ণের হিন্দুদের নিপীড়নের ভয়ও ছিল কোন কোন ক্ষেত্রে৷…”
মুনতাসীর মামুন, বাংলাদেশের উৎসব; পৃ . ৩০-৪০ (ঢাকা: বাংলা একাডেমি, প্রথম প্রকাশ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৪)