আলোকায়নের সিলসিলা
বেশ কয়েকমাস ধরে পোস্ট-কলোনিয়াল স্টাডিস নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করছিলাম। পোস্ট-কলোনিয়াল বুঝতে গেলে আপনাকে আগে কলোনিয়াল বুঝতে হবে। আর কলোনিয়াল এর গোঁড়া খুঁজতে খুঁজতে একপর্যায়ে দেখবেন আপনি এনলাইটেনমেন্ট এ চলে এসেছেন। এই এনলাইটেনমেন্ট/আলোকায়ন/আধুনিকায়ন/পশ্চিমায়ন এর অন্যতম অঙ্গ ছিল বর্ণবাদ ও এন্টি-সেমিটিজম। এই এন্টি-সেমিটিজম মানে কিন্তু শুধু ইহুদী বিদ্বেষ না, বরং মূলত এটি ছিল ইসলাম ও মুসলিম বিদ্বেষ। দীর্ঘদিন হত্যা, জোরপূর্বক ধর্মান্তরকরণ, উদ্বাস্তুকরণ, বিতাড়ন ইত্যাদির মাধ্যমে ইউরোপ তা আঞ্জাম দিয়েছে। পরে রয়ে গিয়েছিল শুধু ইহুদিরা। হিটলার বিবর্তনীয় মতাদর্শিক ও রাজনৈতিক স্বার্থে যাদের টার্গেট করে। গতবছর আমি খুবই অবাক করা একটা তথ্য জানতে পাই একজন নৃতত্ত্ববিদের লেখায়। ইতালির নামকরা দার্শনিক জর্জিও আগামবেনের হাওলাতে তিনি জানান, আগামবেন যখন অসউইচের বেঁচে যাওয়া নানান বন্দীর জবানী আর লেখনীগুলো যখন পর্যবেক্ষণ করছিলেন, তিনি টের পান, বন্দীদের প্রায় অনেককেই সেখানে ‘মুসলমান’ বলে ডাকা হত। আমি বেশ অবাক হয় এতে। কেন মুসলমান বলে ডাকা হত? চলুন নৃতত্ত্ববিদ খন্দকার রাকিবের সেই লেখাটা পড়ে আসি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সবচেয়ে নিষ্ঠুরতম বন্দিশালা অসউইচের বেঁচে যাওয়া বন্দীদের স্বাক্ষী এবং নানাবিদ আর্কাইভাল ডকুমেন্টারি নিয়ে ‘Remnants of Auschwitz’ নামে একটা দারুণ কাজ করেছিলেন জর্জিও আগাম্বেন। অসউইচের নির্যাতনের ধরণগুলো নিয়ে ইউটিউবেই নানান ডকুমেন্টারি পাওয়া যায়। বন্দীদের না খাইয়ে রাখা, গ্যাস চেম্বারে নিয়ে মেরে ফেলা, শরীরের উপর নানাবিধ আধুনিক ঔষধের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাসহ অসংখ্য অমানবিক নির্যাতনের মধ্য দিয়ে খুন করা হত এখানকার বন্দীদের।
বন্দীদের চাইলেই নাৎসি বাহিনীর লোকেরা শুরুতেই মেরে ফেলতে পারত, কিন্তু তারা তা না করে তাদের শরীরের উপর এমন নিষ্ঠুর বর্বরতম অত্যাচার করেছিল। তাদের উপর অত্যাচার সম্ভব হয়েছিল, কেননা নাৎসিরা তাদেরকে ‘মানুষ’ এবং ‘অমানুষ’ এই দুই ক্যাটাগরির মাঝামাঝি মনে করত। এটা নিয়ে আগাম্বেনের হোমো স্যাকার নিয়ে আলাদা কাজ ই আছে, কিভাবে ডিউম্যানাইজ করা হত বন্দীদের। বন্দীদের একটা বড় অংশ ছিল ইহুদী, অথবা স্পেন-সোভিয়েত-ফ্রান্স সহ জার্মানির শত্রু রাষ্ট্রের নানান বাসিন্দা।
তো আগাম্বেন অসউইচের বেঁচে যাওয়া নানান বন্দীর জবানী আর লেখনীগুলো যখন পর্যবেক্ষণ করছিলেন, তিনি টের পান, বন্দীদের প্রায় অনেককেই সেখানে ‘মুসলমান’ বলে ডাকা হত। আগাম্বেন হয়ত ভেবেছিলেন, ‘মুসলমান’ শব্দটা নিয়ে যেহেতু একধরণের স্টেরিওটাইপ চিন্তা ইউরোপে বিদ্যমান ছিল সেকারণেই হয়ত বন্দীদের এমন নামে ডাকা হত। এটা নিয়ে অবশ্য তিনি আর লিখেন নাই তেমন পরে।
আগাম্বেনের এই লেখাটা দেখার পর এন্থ্রপলজি অব খ্রিস্টিয়ানিটির অন্যতম প্রভাবশালী চিন্তক গিল আনিদজারকে এই প্রশ্নটা দারুণভাবে নাড়া দেয় যে কেন অসউইচের বন্দীদের একটা অংশকে ‘মুসলমান’ বলা হত। এই প্রশ্নটা তাঁকে এমন কুড়ে কুড়ে খেয়েছে যে শেষতক তিনি ‘The Arab, the Jew and the History of Enemy’ নামে দুর্দান্ত একটা লেখা লিখেছিলেন।
আনিদজার তার আলোচনার সূত্রপাত করেন পশ্চিমা ইউরোপীয় চিন্তার জিনিওলজি ধরে। আনিদজার দেখান, রাজনৈতিকভাবে-সাংস্কৃতিকভাবে এবং দর্শনের জায়গা থেকে খোদ ইউরোপ নিজেকে ইউরোপ আকারে কল্পনা করতে গিয়ে তাকে অবশ্যম্ভাবীভাবে ইসলাম প্রশ্নকে ডিল করতে হয়েছে। ইউরোপের মধ্যে ইসলামকে নানাভাবে যখন মোকাবেলা করা হচ্ছিল এর মধ্যে কোন ‘অপর’ ছিল কিনা এইটাই আনিদজারের প্রশ্ন। আনিদজার পরখ করেন, পশ্চিমা আইন, রাজনীতি এবং জ্ঞানতত্ত্বের চিন্তায় ইসলাম কোথায় কিভাবে ছায়া এবং ছাপ ফেলছে। এই কাজটা করতে গিয়ে ইউরোপের সবচেয়ে প্রভাবশালী তিনজন চিন্তককে (কান্ট, মন্তেস্কু, হেগেল) ধরে একটা চ্যাপ্টারে আলাপ করেন আনিদজার।
প্রথমত, জ্ঞানের ক্ষেত্রে কান্ট, যিনি মনে করতেন ইউরোপের জ্ঞানের উতস ‘রিজন’ এবং ‘সেন্স’। ট্রান্সিডেন্টাল বা অতীন্দ্রিয় জ্ঞানকে প্রশ্ন করতেন তিনি। পরবর্তীতে এই আলাপের সূত্র ধরে বলা হল, মুসলিমরা অতীন্দ্রিয়তায় বিশ্বাসী।
দ্বিতীয়ত, আইন প্রশ্নে মন্টেস্কু। আধুনিক ইউরীপিয় চিন্তায় আইনের দর্শনকে সংজ্ঞায়িত করতে গিয়ে মন্টেস্কু দেখান ইউরোপের আইনের ভিত্তিটা হচ্ছে ‘আইনের শাসন’। ইউরোপ ইউরোপ হতে পেরেছে যেহেতু এখানে আইনের শাসন আছে। আর আইনের শাসনের বিপরীত কি? সেটা স্বৈরতন্ত্র বা ‘ডেস্পটিজম’। মন্টেস্কুর মতে এই ডেস্পটিজমের সাক্ষাত উদাহরণ হচ্ছে মুসলমান আর ওসমানীয়রা। মন্টেস্কুর প্রশ্ন কেন আরবে কোন আইন নাই, ডেস্পটিজম আর কর্তৃত্ববাদ আছে? মন্টেস্কুর মতে মুসলমান সমাজে কর্তৃত্ববাদ থাকার অন্যতম কারণ ইসলাম, কারণ ইসলামের মধ্যেই কর্তৃত্ববাদের উপাদান আছে। (বাংলাদেশের প্রেক্ষিতেও ইদানিং এই ধরণের ব্যাখ্যা দেখবেন, বাংলাদেশে কর্তৃত্ববাদী শাসন থাকার অন্যতম কারণ নাকি ইসলাম)।
তৃতীয়ত, বিশ্ব ইতিহাস প্রশ্নে হেগেল। হেগেল বিশ্ব ইতিহাস নিয়ে লিখতে গিয়ে ইতিহাসে ইসলামকে আলাদা একটা বর্গ করেন। ইসলাম তার কাছে একটা মোমেন্ট। কিন্তু এটা “এবসোলিউট ট্রুথ না, আনফোল্ডিং মোমেন্ট”। হেগেলের মতে এবসলিউট ট্রুথ পাওয়ার উপায় খৃষ্টধর্মতত্ত্বের ভিতরে বেড়ে উঠা আধুনিকতা।
ফলে আনিদজার দেখান ইউরোপ নিজেকে ইউরোপ আকারে কল্পনা করতে গিয়ে এমন এক ‘অপর’ তৈরি করেছে, যে অপরটা সেমাইট, মুসলমান (ইহুদীও, আমি বিস্তারিত যাচ্ছিনা এখানে)।
এটা এমন এক ক্যাটাগরি যেটাকে তারা ‘মানুষ’ এবং ‘অমানুষ’ এর মাঝামঝি ভাবে। এই ভাবাভাবিটা ইউরোপের কল্পনায় প্রতিদিনের শ্লোকে, বাতিচিতে বিদ্যমান ছিল। ফলে অসউইচে যেসব বন্দীদের অমানবিক অত্যাচার করা হচ্ছিল, তাদের অবস্থাকে মুসলমানদের অবস্থার সাথে কল্পনা করা হত। তারা মনে করত এইটা মুসলমানদের অবস্থা, এইজন্যেই বন্দীদের বলা হত ‘মুসলমান’। এই বন্দী, লেস দেন ‘হিউম্যান’।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের এই অবস্থা পেরোনের বহু পরেও এই কল্পনা থেকে ইউরোপ এখনো বেরিয়ে আসতে পারে নি। ম্যাক্রোর ইসলাম নিয়ে সাম্প্রতিক মন্তব্য দেখে মনে হচ্ছে, বেরিয়ে আসা অনেক দূর অস্ত এখনও। ফলে, মুসলমানদের ‘ফ্রেঞ্চ ইসলামে’ জোর করে ট্রান্সফরমেশন করার এই চিন্তা মুসলমানকে মানুষ না ভাবার যে কল্পনা, সেটার ই সিলসিলা।