তিতুমীর-পরিচালিত বারাসতের ওয়াহাবী বিদ্রোহ বঙ্গদেশের কৃষক-সংগ্রামের ইতিহাসে এক বিশিষ্ট ঘটনা। এই বিদ্রোহ সম্বন্ধে এককালে আমাদের দেশের লেখকগণের মধ্যে যথেষ্ট মতভেদ ছিল। প্রাচীনপন্থীদের অনেকে এই বিদ্রোহকে “হিন্দু-বিদ্বেষী সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামা” আখ্যা দিয়াছেন। নদীয়া জেলার ইতিহাস-রচয়িতা কুমুদনাথ মল্লিক মহাশয়ও তাঁহার “নদীয়া কাহিনীতে” তিতুমীরের নেতৃত্বে পরিচালিত “বারাসত বিদ্রোহ”কে “ধর্মোন্মাদ মুসলমানদের কাণ্ড” বলিয়া উল্লেখ করিয়াছেন (পৃ: ৭৫)। কিন্তু বর্তমান কালের সত্যানুসন্ধিৎস্থ ইতিহাস গবেষক-গণের প্রায় সকলেই ইহাকে জমিদার নীলকরগোষ্ঠীর শোষণ-উৎপীড়নের বিরুদ্ধে কৃষক জনসাধারণের সশস্ত্র অভ্যুত্থান বলিয়া ব্যাখ্যা করিয়াছেন।
প্রথমোক্ত দলের মধ্যে এমন কি বঙ্গদেশের সংগঠিত কৃষক-আন্দোলনের প্রথম যুগের অন্যতম নায়ক ডা. ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত মহাশয়ের মত কৃষকদরদী ব্যক্তিও রহিয়াছেন! তিনি এই ঐতিহাসিক বিদ্রোহকে হিন্দু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে মুসলমান সম্প্রদায়ের Direct Action (সাম্প্রদায়িক আক্রমণ) নামে অভিহিত করিয়াছেন।
তৎকালীন নীলকর-জমিদার গোষ্ঠীর শোষণ-উৎপীড়ন ও সামন্ততান্ত্রিক প্রভূত্বই যে ওয়াহাবী নায়ক তিতৃমীর কর্তৃক আরব্ধ মুসলমান ধর্মের সংস্কার-আন্দোলন হইতে এই ব্যাপক কৃষক-বিদ্রোহকে জাগাইয়া তুলিয়াছিল-এই সত্য ডা. দত্ত আবিষ্কার ও উপলব্ধি করিতে পারেন নাই। কিন্তু ইংরেজ ঐতিহাসিক থর্নটনের যে গ্রন্থ এবং ১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দে “বঙ্গবাসী” পত্রিকায় প্রকাশিত বিহারীলাল সরকার মহাশয়ের এই বিদ্রোহ সন্বন্ধীয় যে বিবরণ পাঠ করিতে দত্ত মহাশয় উপদেশ দিয়াছেন তাহাতে স্পষ্টই লিখিত হইয়াছে যে, জমিদারগণের শোষণ-উৎপীড়নই তিতৃমীরের “শান্তিপূর্ণ ধর্মসংস্কার-আন্দোলনকে” ব্যাপক বিদ্রোহে রূপান্তরিত করিয়াছিল।

থর্নটন বলিয়াছেন, তিতুমীরের শান্তিপূর্ণ ধর্মসংস্কার-আন্দোলনকে অহেতুক ভীতির চক্ষে দেখিয়া এবং ইহাকে কর আদায়ের অজুহাত রূপে ব্যবহার করিয়া (হিন্দু) জমিদারগণ মুসলমান কৃষকের উপর যে উৎপীড়ন আরম্ভ করেন তাহাই এই বিদ্রোহের মূল কারণ। ইংরেজ নীলকরদের অমানুষিক শোষণ-উৎপীড়নও যে এই বিদ্রোহে ইন্ধন যোগাইয়াছিল তাহা নীলকরদের সহিত তিতুমীরের সংঘর্ষের বিবরণ হইতেই বুঝিতে পারা যায়। বিহারী-
লালের পুস্তিকার বিভিন্ন স্থানে এই সংঘর্ষের উল্লেখ আছে।
থর্নটন ও বিহারীলাল ব্যতীত ইংরেজ ঐতিহাসিক ও তথ্যানুসন্ধানী উইলিয়াম হান্টারও তাঁহার Indian Mushalmans নামক গ্রন্থে “বারাসত বিদ্রোহ”কে মুসলমান সম্প্রদায়ের ধর্মসংস্কার-আন্দোলনের রূপে হিন্দু-মুসলমান নির্বিচারে “জমিদার-গোষ্ঠীর” বিরুদ্ধে কৃষকের গণ-অভ্যুত্থান বলিয়া ব্যাখ্যা করিয়াছেন। ওকেনলি সাহেব-লিখিত ওয়াহাবী আন্দোলনের বিবরণেও বলা হইয়াছে যে, মুসলমানদের শান্তিপূর্ণ ধর্মসংস্কার আন্দোলন জমিদারগোষ্ঠীর উৎপীড়নের ফলে বিদ্রোহের আকার ধারণ করিয়াছিল। একালের একজন শ্রেষ্ঠ গবেষক, লাহোরের ফরমান কলেজের ঐসলামিক ইতিহাসের ভূতপূর্ব অধ্যাপক উইলফ্রেড ক্যান্টওয়েল স্মিথ সাহেবও তাঁহার Modern Islam in India নামক বিখ্যাত গ্রস্থে বারাসতের বিদ্রোহকে জমিদার-নীলকরগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে কৃষকের শ্রেণী-সংগ্রাম বলিয়া ব্যাখ্যা করিয়াছেন।
এই সকল বিবরণের মধ্যে বিহারীলাল সরকার মহাশয়ের বিবরণই বিস্তৃতভাবে লিখিত। বারাসত বিদ্রোহের ছেষট্টি বৎসর পরে জনশ্রতি ও সরকারী বিবরণের উপর ভিত্তি করিয়া এই বিবরণ রচিত। ইহা প্রথমে খ্রিস্টাব্দে “বঙ্গবাসী” পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে এবং পরে পুস্তিকাকারে “তিতুমীর” নামে প্রকাশিত হয়। বিহারীলাল সরকার মহাশয়ও প্রাচীনপন্থীদের অন্যতম। তিনি এই পুস্তিকা রচনার উদ্দেশ্য সম্বন্ধে লিখিয়াছেন:
“হিন্দু হউক, মুসলমান হউক, খ্রীষ্টান হউক, শিখ হউক, পারসিক হউক, তিতুর ন্যায় যদি কখনও কাহারও দুর্বুদ্ধি হয়, ভ্রান্তি হয়, তিতুর দৃষ্টান্তে নিশ্চিতই তাহার চৈতন্য হইবে। তিতু বড়ই দূর্বদ্ধি। তাই তিতু বুঝিল না, ইংরেজ কত ক্ষমাশীল, কত করুণাময়! দুর্বুদ্ধি তিতু ইংরেজের সে করুণা, সে মমতা! বৃঝিল না। … এ ভারতের ইংরেজের রাজত্বে ইংরেজের করুণার মর্ম, ইংরেজের বাৎসল্যের ভাব, কে না বুঝে। ইংরেজের রাজত্বে সুখামৃতের নিত্য সুখাস্বাদ কে না করে ?
এই পরম ইংরেজভক্তটিই বারাসতের কৃষক-বিদ্রোহের নায়ক তিতুমীরের একমাত্র বাঙালী জীবনীকার! তিনিও বুঝিতে সক্ষম হন নাই যে, এই বারাসত বিদ্রোহের বহিরাকৃতি ধর্মীয় হইলেও জমিদারগোষ্ঠী ও নীলকুঠির শোষণ-উৎপীড়নের বিরুদ্ধে কৃষকের সংগ্রামই ইহার প্রধান বিষয়বস্তু। তাই জমিদারগোষ্ঠীর শোষণ-উৎপীড়নের কথা স্বীকার করিয়াও বিহারীলাল এই বিদ্রোহের মূল প্রকৃতি হিন্দু-বিরোধী বলিয়া রায় দিয়াছেন।
প্রাচীনপন্থী লেখকগণ বুঝিতে পারেন নাই যে, ভারতবর্ষের মত যে সকল দেশের সমাজে সামন্তপ্রথার প্রাধান্য বর্তমান, সেই সকল দেশের জনসাধারণ অর্থাৎ কৃষকের ধর্মও জমিদার ও শাসকগোষ্ঠীর শোষণের শিকারে পরিণত হয় এবং জনসাধারণের সংগ্রাম ধর্মীয় বা যে কোন ধ্বনি লইয়াই আরম্ভ হউক না কেন, তাহা শেষ পর্যস্ত অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংগ্রামে পরিণত হইতে বাধ্য। ইহা আজ সন্দেহাতীত রূপে প্রমাণিত যে ভারতের দীর্ঘতম কৃষক-অভ্যুত্থান, ১৮৩০-৭০ খ্রীষ্টাব্দের ওয়াহাবী বিদ্রোহ, প্রথমে ধর্মের ধ্বনি লইয়া আরস্ত হইয়াছিল এবং ক্রমশ তাহা ভারতব্যাপী কৃষক-বিদ্রোহে
পরিণত হইয়াছিল।
তথ্যসূত্র: সুপ্রকাশ রায়, ভারতের কৃষকবিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম, পৃ. ২৬১-২৬৩ (কলকাতা: ডিএনবিএ ব্রাদার্স, ৩য় সংস্করণ এপ্রিল ১৯৮০)