কেইস স্টাডি – শামির মোন্তাজিদ

শামির মোন্তাজেদের মত সেলিব্রেটিরা দেশে থাকতে শিক্ষা-ব্যবসার মাধ্যমে জনপ্রিয়তা পায়, এ সময় ধর্ম-অধর্ম কোনোটাতেই তাদের প্রকাশ্য মাথাব্যথা থাকে না। না ধর্মকে ছোট করে নাইবা অধর্মের পক্ষে সাফাই গায়। কিন্তু বিদেশ যাওয়ার সুযোগ পাওয়ার পর কিছুদিন পরেই তাদের ইসলামবিরোধী চেহারা প্রকাশ পেয়ে যায়। বই বিক্রির জন্য ১ম বইতে ফ্রানসিস বেকনের উক্তি দেয়া, মায়ের সাথে হজ্জে গিয়ে ছবি দেয়া এগুলো হয় ছাত্র-ছাত্রীর কাছে জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা অর্জনের কৌশল মাত্র। তারপর একে একে রেড ডিস্ট্রিকটের বেশ্যাদের নারীর ক্ষমতায়ন এর নমুনা হিসেবে উপস্থাপন করে, সমকামি বি-কৃ-তি-র উদাত্ত সমর্থন জানায়, রাসূল (স) ও তাঁর নবুওয়াত নিয়ে ব্যঙ্গ করা এসব চলতে থাকে। অথচ একটু সৎ হলে অক্সফোর্ড থেকে প্রকাশিত বইপত্রেই রাসূল (সা) কে নিয়ে সে কটূক্তি করেছে তার জবাব খুঁজে পেত।
শামিরের মত লোকজনের সমস্যা শুধু একার না, এটা তাদের পরিবেশের, বেড়ে উঠার। কেউ বলবে ভিসার মেয়াদ বাড়ানোর জন্য সে এসব করতেছে, সে জাতে উঠতে চাচ্ছে-সেখানে বাদামি চামড়ার দাম কম ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি জানি না এসবের কোনটা সঠিক। বাট এতটুকু মনে করি—এর দায় মধ্যবিত্তের বাবা-মায়েরও রয়েছে। তারা সন্তানকে শিখায় নি কেন সে মুসলিম, তার পরিচয় কী, তার আদর্শ কে? কারিকুলামের যে পড়াশোনা সে করেছে সেগুলোও আমাদেরকে চাকর ও অনুগত বানানোর জন্যই তৈরি করা। অনলাইনের ১০ মিনিটসহ অফলাইনের শিক্ষা-ব্যবসায়িরা সেই কাজটাই করছেন। শিক্ষিত শহুরে মধ্যবিত্ত সমাজের প্রবাহে গা ভাসিয়ে চলতে চায়। কারণ তাদের জীবনের লক্ষ্য দুনিয়ার ভোগ, চাকরি, টাকা, ডমিনেন্ট লাইফ স্টাইল। এর মাঝেই নিজের সন্তানদের বেড়ে উঠতে দেন তারা। ইসলাম, আল্লাহ, রাসূল (সা) এগুলো থাকে নিছক কিছু আচার-প্রথায় সীমাবদ্ধ ও দপ্তরি কাগজের লেখায়। অধিকাংশ মানুষের ইসলাম সম্পর্কে জ্ঞান প্রায় শূন্যের কোটায়। তারা ইসলামের বিধান নানামাত্রায় অপছন্দ করেন কিন্তু তারপরও তারা আল্লাহ বা রাসূল (সা) নিয়ে সরাসরি কটূক্তি করতে চান না। এদের সন্তানই যখন তারুণ্যের স্বাদ পায়, দেশের বাইরে যায় তখন যে জীবনের জন্য তাদের বড় করা হয়েছে সেই জীবনের মোহে নিছক আচারগত পরিচয় ছুড়ে ফেলতে বেশি সময় লাগে না। কারণ তারা শুরুতেই জানতো কেন তারা মুসলিম। ছিল না আত্মপরিচয়।
পরিচয় খুঁজে পেতে চলুন না রাসূল (সা) সম্পর্কে জানি, বই পড়ি।
কেন তিনি একজন সত্য নবী?
- হামজা যর্জিস, দ্য ডিভাইন রিয়ালিটি (অধ্যায় ১৪)
- ড. রাগেব সারজানি, উসওয়াতুল লিল আলামিন
- মোহাম্মদ তোয়াহা আকবর, কে উনি?
কেন পশ্চিম ও পশ্চিমের অনুগতরা তাকে (সা) সহ্য করতে পারে না তার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
- ক্যারেন আর্মস্ট্রং, মুহাম্মাদ দ্য বায়োগ্রাফি অফ প্রফেট (অধ্যায় ১)
রাসূল (সা) এর জীবনী
- সফিউর রহমান, আর রাহিকুল মাখতুম
মিরাকল বা মুজিজা যৌক্তিক কি-না সে বিষয়ে আমি একটা ফিলসফিকাল প্রবন্ধ গুছিয়েছি। সামনে আসবে ইন শা আল্লাহ
শামিরের মত লোকজনের কাছে যারা আছেন তাদের উচিত এদেরকে স্নেহ দিয়ে বুঝানো। তাদের দাওয়াহ দিন। অনুপ্রাণিত করুন। এরা দুনিয়া ভোগের জাহান্নামে নিজেকে পুড়াতে চাইছে। এরা আমার আপনারই ভাই। এদের জন্য দুয়া করি, এদের হেদায়েতের জন্য চেষ্টা করি। আমাদের সন্তানরা যাতে এমন না হয় তাই ছোট থেকেই তাদের গড়ে তুলি। নবীজির (স) জীবন যারা বুঝার চেষ্টা করেছেন তারা কিন্তু শামিরের চিন্তার অসংলগ্নতা ঠিকই ধরতে পারবেন, যেমন অনলাইন এক্টিভিস্ট আসিফ সিবগাত লিখেছেন:
যে ব্যক্তি এলএসডি সেবন করে হ্যাল্যুসিনেশনে ভুগে সেটাকে নবুওয়্যাত মনে করেছে – তার মদ, জুয়া ও ব্যাভিচারকে হারাম করে যাওয়ার কথা কি? আর কষ্ট করে প্রতি রাত তাহাজ্জুদের নামাজ পড়ার দরকার কী ছিলো তার – মাদক সেবন করেই তো সিদরাতুল মুনতাহায় পৌঁছে যেতে পারতেন।
যে নবী (সা.) নামাজে আসার আগে পেঁয়াজ ও রসুন খেয়ে মুখে দুর্গন্ধ তৈরি করতে নিষেধ করেছেন তিনি মাদক সেবন করতেন বা অন্য কোনো উপায়ে হ্যালুসিনেটেড হতেন এমনটা মনে করার পেছনে তাকে ভালো করে না জানাটাই দায়ী। নবীকে (সা.) ভালো করে চিনুন এবং তার সীরাত ও হাদীস অধ্যয়ন করে দেখুন আল্লাহ্র সাথে ও প্রত্যেক স্তরের মানুষের সাথে তার আচরণ সব সময়ই কতটা সুন্দর, সংযত, এবং সহানুভূতিশীল ছিলো। ক্যারেন আর্মস্ট্রং বা তার মত অন্যান্য নিরপেক্ষ অমুসলিম বায়োগ্রাফাররা নবীকে (সা.) কীভাবে দেখেছেন সেটা অন্তত লক্ষ্য করতে পারেন। চরিত্রের এতটা পারফেকশন যা নবীর ব্যাপারে বর্ণিত হয়েছে তা একজন ঔপন্যাসিকের পক্ষে সম্ভব নয় তার গল্পের নায়কের জন্য বরাদ্দ করা।
নবী হ্যালুসিনেশনে ভুগতেন – মাদক দিয়ে হোক বা অন্য কোনোভাবে – এধরণের থ্যট এক্সপেরিমেন্টেশন করার জন্য উচ্চশিক্ষা বা আধুনিক মুক্তবুদ্ধির দরকার নেই – নবীর (সা.) সময়ের লোকেরাই এরকম থ্যট এক্সপেরিমেন্ট করেছিলো। আল্লাহ্ এর জবাব দিয়েছেন কুরআনে।
“এটি একজন মহানুভব বার্তাবাহকের বাণী। যিনি প্রভুত শক্তির অধিকারী, আরশের অধিপতির কাছে মর্যাদাপ্রাপ্ত। যিনি মাননীয় ও বিশ্বস্ত। আর তোমাদের সঙ্গীটিও বিকারগ্রস্থ নয়। তিনি তাকে (ফেরেশতা জিবরীলকে) দেখেছেন স্পষ্ট দিগন্তে। আর সে অদৃশ্যের (যা তাকে দেখানো হয়েছে) ব্যাপারে (প্রকাশ করার ব্যাপারে) তিনি কুন্ঠিত নন। আর এটি অভিশপ্ত শয়তানের কথাও নয়। তবে আর কোথায় চলেছো তোমরা? নিশ্চয়ই এটি সমস্ত বিশ্বের জন্য একটি স্মরণিকা ছাড়া কিছু নয় – তার জন্য যে সোজা পথে চলতে চায়।”
[সূরা তাকউইর ১৯-২৮]
আয়াতগুলোর শুরুতে যে বার্তাবাহকের কথা হচ্ছে তিনি হলেন ফেরেশতা জিবরীল (আ.)। আর ‘তোমাদের সঙ্গী’ বলে নবীকে (সা.) বোঝানো হচ্ছে – মক্কার কুরাইশদের উদ্দেশ্যে।
যিনি এই থ্যট এক্সপেরিমেন্ট করতে চান যে – যে ব্যক্তি নিজেকে নবী দাবী করছেন তিনি আসলে যা দেখেছেন তা হ্যালুসিনেটেড হয়ে দেখেছেন কিনা – তিনি তার এক্সপেরিমেন্ট এখানেই থামিয়ে দিচ্ছেন কেন? চিন্তাটা আরেকটু এগিয়ে এটাও চিন্তা করা যায় যে মাদক সেবন করুক আর নাই করুক – আসলেই মানুষ সত্যি করে কিছু দেখতে বা জানতে পায় কিনা। আমাদের সেন্স এক্সপিরিয়েন্স যত ত্রুটিমুক্ত থাকুক – এর ওপর কতটা আস্থা রাখতে পারি আমরা। সবই যে আমাদের মস্তিষ্কের অক্সিপিটাল লোবে এসে ভুল ভাবে ইন্টারপ্রেটেড হচ্ছে না তা আমরা আদৌ কি বলতে পারি? হয়তো সত্যিটা আল্লাহ্ই দেখাতে পারেন এবং দেখান অল্প কাউকে। হয়তো কেবল নবীদেরই তিনি সত্যটা দেখিয়েছেন। আমরাই কোনো না কোনো অর্থে ‘হ্যালুসিনেটেড’। বিশ্বাস করা বা না করা তো পরের প্রশ্ন। থ্যট এক্সপেরিমেন্ট তো এভাবেও হতে পারে, হওয়া উচিৎও। দার্শনিকরা করেছেনও।
শামির মোন্তাজিদরা বুদ্ধিমান ছেলে। তারা ঠিক করবেন তারা কী বিশ্বাস করবেন। কিন্তু তাদের কাছে আমার অনুরোধ থাকবে যে থ্যট এক্সপেরিমেন্টকে সত্য অনুধাবনের সার্বিক প্রশ্নে সংকীর্ণ করে না রেখে জানা অজানার বিভিন্ন আঙিকে সবকিছুকে তলিয়ে দেখবেন। আস্তিক নাস্তিক সবধরণের মানুষেরই চিন্তার পরিসরে ত্রুটি বিচ্যুতি থাকতে পারে। তাই সবারই দায়িত্ব আছে জ্ঞানের প্রশ্নে বুদ্ধি ও মনকে খোলা রেখে চিন্তা করা। একটি নির্দিষ্ট আঙিকে চিন্তা করতে পারলেই কেবল মন খোলা থাকে – এটা নিজেই একটি বদ্ধ ধারণা। আমাদের নবী (সা.) নিজে অত্যন্ত বুদ্ধিমান ও জ্ঞানী ব্যক্তি ছিলেন – এটি তার নবী পরবর্তী জীবনে – কথা ও কাজে – বহুবার প্রকাশ পেয়েছে। নবী হওয়ার আগে তিনি সত্যকে বোঝার ক্ষেত্রে নিজের তুলনামূলক অধিক প্রজ্ঞার ওপর আস্থা রেখে নিজে নিজে সব থিওরি আবিষ্কার করেননি। বরং নিজের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা বুঝতে পেরে আকুল হয়ে হেরা গুহায় রাতের পর রাত ধ্যানে নিমগ্ন থাকতেন বাইরে থেকে আসা কোনো অপার সাহায্যের আশায়। এখানে জ্ঞানের যে প্রথম গুরুত্বপূর্ণ জিনিস – বিনয় – তা তিনি সর্বোচ্চ ভাবে প্রদর্শন করেছেন বলে আমার বিশ্বাস। আমাদের থ্যট এক্সপেরিমেন্ট করতে বাধা নেই। কিন্তু বিনয় থাকা জরুরি কেননা বিনয় চিন্তার প্রসারতাকে তথাকথিত শিক্ষার ওপরে উঠে আসতে সাহায্য করবে।
আমরা আশা করবো শামিরের মত লোকজন তাদের বাবল থেকে বের হয়ে আসবে। যদি বের হয়ে না আসে তাহলে মূল্যায়ন কেমন হবে? সেটা শামিরের থেকেই শুনি না হয়:

“ফেসবুক আপনাকে একটা বাবলের মধ্যে আটকে রাখে। কারণ ফেসবুক অ্যালগরিদমের মূখ্য উদ্দেশ্য হলো আপনাকে লাইক কামাতে দেয়া। আপনি বেশী লাইক পেলে বেশীক্ষণ ফেসবুকে বসে থাকবেন; জাকার্গবার্গ সাহেবের ব্যবসা ভালো হবে। .কিন্তু, আপনি কখন বেশী লাইক পাবেন?.উত্তর: যখন আপনার পোস্ট আপনার সম-মানসিকতার মানুষ তার হোমপেজে দেখতে পারবে। সুতরাং, আপনার তিন হাজার বন্ধু থাকুক আর তিন’শ বন্ধু থাকুক তাতে কিছু যায় আসবে না। আপনার হোমপেজে ঘুরে ফিরে আপনার মন-মানসিকতা বন্ধুদেরই পোস্টই দেখতে পাবেন। এর মানে এই নয় যে, আপনার ভিন্ন মানসিকতার মানুষ দুনিয়াতে নেই! তাদের পোস্ট ফেসবুক আপনাকে দেখতে দেয় না।.এভাবে ফেসবুক চালাতে চালাতে এক সময় আপনার মাঝে এক কঠিন ভ্রান্ত ধারণা সৃষ্টি হবে—“আপনি যা ভাবেন তাই তো দেখি ঠিক। কারণ আপনার স্ট্যাটাসে তো লাইক আসছেই!”.আমিও একই রকম ভাবতাম। তারপর গত জুন মাসে আমার একটা ছবি আমার ফেসবুক বাবলের বাহিরে চলে যায় (কারণ অনেক মানুষ সেটা শেয়ার করেছিলো)। জীবনে প্রথম বারের মতো বুঝতে পেরেছিলাম, আমার মতের বিরোধী মানুষের সংখ্যা অনেক-অনেক-অনেক বেশী। ফেসবুকের অ্যালগরিদম ব্যবসার খাতিরে আমাকে বোকা বানিয়ে বাবলের মাঝে বসিয়ে রাখে। আমাকে বোঝাতে চায় দুনিয়ার সবাই আমার পোস্ট দেখার জন্য মুখিয়ে আছে। আসলে কেউ দুই পয়সার কেয়ারও করে না।.বাবলের মধ্যে আমরা বুদ্ধিজীবী, বাবলের বাইরে বাইনচোদ।”