Physician | Author | Blogger

বাঙালিয়ানা ও অসাম্প্রদায়িকতার সুলুক সন্ধান

এক নজরে

বাঙালি সমাজ বলতে উনিশ শতকে হিন্দুসমাজকেই বোঝানো হতো। বাংলাভাষী মুসলমানদের কখনো বাঙালি পরিচয়ের সুযোগ দেওয়া হয়নি। বাঙালি সংহতি চেতনাকে (আসলে হিন্দুত্ববাদী ধারণা) আপাতদৃষ্টিতে ধর্মনিরপেক্ষ, উদার গণতান্ত্রিক বোধজাত রাজনৈতিক মতাদর্শ বলে প্রতীয়মান হলেও, এতে প্রতিভাসিত হয়েছে হিন্দু অধ্যাত্মবাদ, যার প্রাণশক্তি সঞ্চারিত হয়েছে শক্তিরূপিণী কালী এবং গীতার প্রভাবসঞ্জাত মূল্যবোধ থেকে।

বিস্ময়কর দিক হচ্ছে যে ভারতীয় জাতীয়তাবাদীদের মধ্যে কেউ কেউ ব্রাহ্ম অথবা আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার পরও জাতীয়তাবাদের সাম্প্রদায়িক অনুসঙ্গের দিকটির নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার কথা বিবেচনায় আনেননি। ভারতীয় জাতীয়তাবাদী নেতৃত্ব মুসলমান নেতাদের মতো মাদ্রাসাশিক্ষার মতো কোনো রক্ষণশীল শিক্ষাধারায় শিক্ষিত ছিলেন না। তারা ছিলেন জ্ঞানালোক, হিতবাদী, মানবতাবাদী ও উদারভিত্তিক শিক্ষাক্রমে শিক্ষিত। অথচ ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদের কথা বিবেচনায় এনে প্রতিবেশী সম্প্রদায়ের আবেগ-অনুভূতি জাতীয়তাবাদের কর্মকৌশলে বা ভাবজগতে বাঙালি মুসলমান সম্প্রদায়ের জন্য কোনো পরিসর ছিল না।

উনিশ শতকীয় নবজাগরণের অন্যতম উপাদানই ছিল হিন্দুধর্মীয় চেতনার পুনরুত্থান। পুনরুত্থানের মাধ্যমে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রসার ঘটানো হয়। বাঙালি হিন্দু বুদ্ধিজীবীরা এই পুনরুথানের ধারণার তত্ত্বায়ন করেন তাঁদের সৃষ্ট সাহিত্য, সমাজদর্শন ও ধর্মদর্শনের মাধ্যমে। এই তত্ত্বায়নের পুষ্টি জুগিয়েছে হিন্দু জমিদার এবং পেশাজীবী মধ্যবিত্ত শ্রেণী। শ্রেণীগত অবস্থান থেকেই রামমোহন, ঈশ্বরচন্দ্র, রাজনারায়ণ বসু, বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ ও বিবেকানন্দ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থার বিরোধিতা করলেও চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কারণে সৃষ্ট জটিলতার অনুপুঙখের দিকে দৃষ্টি দেননি। সৃষ্ট জটিলতা ও সমস্যাকে এড়িয়ে গেছেন…

হিন্দু সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে বাংলাভাষী মুসলমানদের বাঙালিত্বের মর্যাদা দেওয়া হয়নি। বাঙালিত্বের অভিধা বাঙালি মুসলমানের নিজস্ব অর্জন। বাঙালি বলতে বাঙালি হিন্দু (বর্ণহিন্দু) নিজেদের বর্ণকেই বুঝেছে। নিম্নবর্ণের হিন্দুরাও বাঙালি হওয়ার গৌরব অর্জন করতে পারেনি। তারা পরিচিত হয়েছে নমঃশুদ্র, মাহিষ্য, কৈবর্ত, জলদাস, রবিদাস নামে ।

বাঙালিত্বের এই ধারণার সৃষ্টি হয়েছে বৈষ্ণব ও শাক্ত বিশ্বাস, স্মৃতি ও পুরাণের সংস্কার; খাদ্যাভ্যাস, পোশাক (ধুতি, পাঞ্জাবি, উড়ুনি); কলকাতা, নদীয়া ও সন্নিহিত অঞ্চলের কথ্য বাংলার সময়ে। .বাঙালি সংস্কৃতির আর্থিক ভিত্তি ছিল চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত। উনিশ শতকে বাঙালিত্বের বিকাশ পর্বের পরিণতি ঘটেছে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রভাবে এবং ঔপনিবেশিক শাসনের প্রয়োজনে। বাঙালিত্বের এই বিকাশের উদ্ভবের কেন্দ্র কলকাতা।


তথ্যসূত্র: রফিক কায়সার, বাংলার মাটি বাংলার জল (ঢাকা: প্রথমা প্রকাশন, প্রথম প্রকাশ ২০০৯) পৃষ্ঠা ৪৬-৪৭, ৬৮

Share This
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp
Share on email
Related Articles
Recent Articles

রাফান আহমেদ-এর বইসমূহ

আলাদাবইওয়াফিলাইফ

Copyright © Rafan Ahmed

No part of the website or posts can be published elsewhere without prior permission from author.  

Copyright © 2021 All rights reserved

error: Content is protected !!