আহমদ ছফা বাংলাদেশের সমকালীন বুদ্ধিবৃত্তির পরিমণ্ডলে একজন প্রভাবশালী বুদ্ধিজীবী- একথা বললে উনোক্তি বা অত্যুক্তি কোনোটিই হবে না। জাতীয়তাবাদী ও বামপন্থি মহলে তো বটেই এমনকি ডানপন্থি মহলেরও কিছু কিছু অংশে আহমদ ছফার গ্রহণযোগ্যতা আছে বলে মনে হয়। বিভিন্ন চিহ্নের মধ্য দিয়ে এর সাক্ষ্য প্রমাণ মেলে বৈকি। বিশেষ করে তার কয়েকটি বই যেমন ‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’ (১৯৭২), “বাঙালি মুসলমানের মন’ (১৯৭৬) এবং “যদ্যপি আমার গুরু” (১৯৯৮) প্রভৃতি বাংলাদেশের বিগত ও সমকালীন তরুণ বেশ কয়েকটি প্রজন্মকে অনেক নাড়া দিচ্ছে। এই বিষয়টি সমঝদারদের দৃষ্টি ও বোধে সহজেই ধরা পড়ছে।
এর কারণ কি?
কেন ছফার রচনা মতাদর্শের বর্ণালিক্রমের এপপ্রান্ত থেকে ও- প্রান্তে বিচরণকারী বর্তমান প্রজন্যের বিভিন্ন শাখা-প্রশাখার কাছে এত আবেদন রাখতে পারছে?
এই প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে আমাদেরকে তার চিন্তা ও লেখায় তার যে মানস প্রতিফলিত হয়েছে তা বুঝতে হবে। তার ডিসকোর্স বা বয়ানের ডিকনসট্রাকশন বা অবিনির্মাণ করতে হবে। ১৯৭১ সালে এদেশে যে গভীর আন্তপ্রাদেশিক রাজনৈতিক সংকট দেখা দিয়েছিল, যাকে বাঙালি যাকে বাঙালি জাতীয়তাবাদীরা মুক্তিযুদ্ধের মহাআখ্যান হিসেবে বয়ান করে চলেছে, তার ভেতরেই আহমদ ছফার উত্থান ও বিকাশ হয়েছিল। অর্থাৎ তার সেই সময়ে কলকাতায় চলে যাওয়া ও ফিরে এসে ‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’ (১৯৭২) নামক বইটি লেখা, তৎকালে সদ্যগঠিত জাসদের মুখপত্র ‘গণকণ্ঠ’ পত্রিকার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রাখা ইত্যাদির মধ্য দিয়ে তিনি বাংলাদেশ আন্দোলনের প্রতি তার অনুরাগ ও আনুগত্য উভয়ই প্রকাশ করেছিলেন। অর্থাৎ তার এইসব কর্মকাণ্ড ও লেখালেখির মাধ্যমে তিনি তার বাঙালি জাতীয়তাবাদী মনের পরিচয় দিয়েছেন।
তবে সেই সঙ্গে তার মনে সে সময়কার সেক্যুলার সমাজতান্ত্রিক চেতনার উপস্থিতিও আমরা টের পাই। তবে যা তাকে একজন আপোষহীন বুদ্ধিজীবীর মর্যাদা দিয়েছে তা হল তার সামগ্রিক প্রতিষ্টান ও প্রথা অগ্রাহ্যকারী ব্যক্তিত্ব ও জীবনযাপন শৈলী । তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদী ও সেক্যুলার বাম ঘরানার প্রতিষ্ঠানপন্থি বুদ্ধিজীবীদের মত একাত্তর-উত্তর লুটপাটের অর্থনীতির উচ্ছিষ্টভোগী ছিলেন না। এর আরেকটি সাক্ষ্য প্রমাণ মওলানা ভাসানী ও তার রাজনীতির প্রতি ছফার প্রকাশিত অনুরাগ ও সমর্থনের ভেতরে আমরা লক্ষ করতে পারি। অর্থাৎ একাত্তর-উত্তর প্রথম শাসনকালে নৈরাজ্যকর রাজনীতি ও অর্থনীতি থেকে তিনি-আদর্শগতভাবে এক হওয়া সত্ত্বেও-নিজেকে দূরে রাখতে পেরেছিলেন। সৎ, সাহসী ও স্পষ্টভাষী বুদ্ধিজীবী হিসেবে এটাই তার উ্থান ও সাফল্যের প্রেক্ষাপট ও কারণ ।
এবারে আসি তার দ্বিতীয় যে গ্রন্থটি বহুল আলোচিত ও উদ্ধৃত সেই ‘বাঙালি মুসলমানের মন” (১৯৭৬) প্রসঙ্গে। এই বইটির মাধ্যমে আহমদ ছফা প্রমাণ করলেন যে ‘প্রচলিত একাডেমিক গবেষণার পরিমণ্ডলের বাইরে থেকেও ভাল বিশ্লেষণমূলক গবেষণা করা যায়। এই বইটির মাধ্যমে তিনি “বাঙালি মুসলমান” বলে একটি মনস্তাত্ত্বিক এনালিটিক্যাল ক্যাটাগরি/টুল উদ্ভাবন ও প্রতিষ্ঠা করলেন। তিনি মধ্যযুগ, প্রাক-আধুনিক ও আধুনিক যুগের বাঙালি মুসলমান মানসের এমন একটি মনস্তাত্ত্বিক বয়ান নির্মাণ করলেন, যা এক হীনম্মন্য, দোদুল্যমান, অগভীর, অক্ষম ও অপারঙ্গম প্রতিকৃতি তৈরি করল।
কিন্তু আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলো এই যে, বাঙালি মুসলমানের এই ভগ্ন, অযোগ্য, পশ্চাৎপদ, দুর্বল, উপরিতলীয় মনের মনোসমীক্ষণ বাঙালি মুসলিমদের প্রতি সহানুভূতিশীল ও অসহানুভূতিশীল উভয় মহলেই খুব গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠল। অর্থাৎ ছফার এই কাজটি অনেক পর্যবেক্ষক ও বিশ্লেষকের মতে আনিসুজ্জামানের ‘মুসলিম মানস ও বাংলা সাহিত্য’ (১৯৬৪) বইতে বাঙালি মুসলিমের যে মানস প্রতিচিত্র প্রতিবিম্বিত হয়েছে তাকেও ছাপিয়ে গেছে। এই ছাপিয়ে যাওয়া যেমন উৎকর্ষের দিক থেকে তেমনই বিশ্লেষণী গভীরতায় ও নিবিড় অনুসন্ধিৎসায়। যদিও আনিসুজ্জামান ও ছফার বয়ানের উৎস ও অভিমুখ মূলত একই বলা যায়।
এক্ষেত্রে তুলনীয় তৃতীয় বিশ্লেষণটি এসেছে কয়েক বছর পরে অসীম রায়ের কাছ থেকে তার “দা ইসলামিক সিনক্রেটিস্টিক ট্রাডিশন ইন বেঙ্গল” (১৯৮৪) বইয়ের মাধামে। এরা সবাই বাঙালি মুসলমানকে দেখিয়েছেন হীনমনা, দোদুল্যমান, অনুতপ্ত, পরনির্ভর, সমন্বয়ী, পশ্চাৎপদ, অক্ষম ও মধ্যম মানীয় হিসেবে। ছফার এই বয়ান উপনিবেশিত কলকাতায় উৎপন্ন ইংরেজ প্রাচ্যবাদী ও তাদের ছত্রছায়ায় বাঙালি হিন্দু ভদ্রলোকের জাতীয়তাবাদী বয়ানের সঙ্গে খুব সহজে মিতালি গড়ে নিতে পারে। অথাৎ এই বয়ান বাংলাদেশ রাষ্ট্র ও বাঙালি মুসলমান আত্মপরিচয়কে একটি সাধারণ বাঙালিত্বের ছত্রছায়ায় শেষমেষ অখণ্ড ভারতের অধীনস্ত অবিভাজা বাংলার স্বেচ্ছুক অংশীদার করে তোলে। আর এখানেই আনিসুজ্জামান ও আহমদ ছফাদের এত রমরমা গ্রহণযোগ্যতা ও উদযাপনের রহস্য।
তবে আনিসুজ্জামান ও আহমদ ছফার মধ্যে যেমন মিল রয়েছে, তেমনই অমিলও রয়েছে। আনিসুজ্জামান যেমন উপরিল্লিখিত বাঙালি জাতীয়তাবাদী বুদ্ধিজীবীর ভূমিকায় যতটা খুল্লামখুল্লা হয়েছিলেন, আহমদ ছফা কখনোই ততটা পরিচ্ছদহীন হননি। তিনি ভারত প্রশ্নে অনেক সময় তার অস্বস্তি ও ক্ষোভ প্রকাশ করতে কুণ্ঠিত হননি। বিশেষ করে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্তাসত্তা সুরক্ষার প্রশ্নে তিনি প্রায়শই সরব হয়ে উঠতেন। কিন্তু এসব প্রতিবাদ এম্পিরিকাল পরিমণ্ডলেই সীমাবদ্ধ থাকত। এসব তার জ্ঞানতাত্ত্বিক, আদর্শিক ও মানসিক পরিগঠনে কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি। অর্থাৎ শেষবিচারে আহমদ ছফাও একজন সেক্যুলার, সমাজতন্ত্রপ্রবণ বাঙালি জাতীয়তাবাদীই ছিলেন ।
তথ্যসূত্র: মনোয়ার শামসী সাখাওয়াত, বাঙালি মুসলমানের বয়ান ও প্রতিবয়ান; পৃ. ২১২-২১৪ (ঢাকা: সিস্টেক পাবলিকেশন্স, ২০২১)