নব্য-নাস্তিকতা প্রচারের একটি অন্যতম খুঁটি হলো ধর্ম ও ধার্মিকেরা সহিংস, যুদ্ধবাজ ও অমানবিক এই দাবি করা। অন্যদিকে নিজেদের মানবিক, শান্তিকামী ও সভ্য হিসেবে বিজ্ঞাপন দেয়া। মানবের ইতিহাস নির্মোহভাবে বিবেচনা করলে এই অতিসরলীকৃত বাইনারি একেবারেই ভ্রান্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু সেই নির্মোহ বিচারের কয়জনের আছে?
যস্তেন গার্ডারের বই সোফির জগত অনুবাদ করে আলোচিত হওয়া সেকুলার অনুবাদক জি এইচ হাবিব কিছুদিন আগে ফেসবুকে কিছু প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেন। সেখানেও দেখি প্রায় একই আলাপ। নাস্তিকেরা ভালো, আস্তিকেরা সহিংস বা মন্দ।

তার এহেন প্রশ্নে আমি বেশ আশাহত হয়েছি। উনার অনুবাদ পড়ে তৈরি হওয়া ভালো লাগা মুহূর্তের মাঝেই কর্পুরের মত উবে গেল। কিন্তু কেন?
এনলাইটেনমেন্ট থেকে যে সেকুলার ভাবধারা শুরু হয় তা জন্ম দিয়েছে নানা জাগতিক ধর্ম। নাস্তিকতা স্রষ্টার অস্তিত্ব অস্বীকার করে, কিন্তু ধর্ম জীবনের যেসব জায়গায় নিয়ে থাকত সেসব জায়গা প্রতিস্থাপন করে। বিশেষ করে ক্ষমতা পেলে। এলাহি হুকুমত বাদ দিয়ে মানবরিচত বিধানের যতসব আদর্শ-মতাদর্শ জন্ম হয়েছে সেগুলোর গোড়ায় ছিল নাস্তিকতার বিজ। ফলে মডার্নিজম, লিবারেলিজম, সোশিয়ালিজম, হিউম্যানিজম, পুঁজিবাদ, যুক্তির ধর্মসহ আর যা আছে সবই একপ্রকারের ধর্ম, সেকুলার বা জাগতিক ধর্ম। আধুনিক কালের সহিংসতার মৌলিক কারণ হলো এইসব সেকুলার মতবাদে বিশ্বাসীরা। বিশ শতকে প্রচার পাওয়া আধুনিকতা হলো অন্যতম সহিংস মতাদর্শ। নাস্তিক ও সমকামি ইতিহাস-শিক্ষক ইউভাল নোয়াহ হারারি বলেছেনঃ
❝বিগত তিনশ বছরকে ক্রমবর্ধমান ধর্মহীনতার (সেকুলার) যুগ হিসেবে আখ্যা দেয়া যায়। ঈশ্বরের ধারণা আছে যেসব ধর্মে, এই সময়ের মাঝে ক্রমশই সেগুলোর গুরুত্ব কমেছে বলা যায়। কিন্তু অন্যান্য যেসব জাগতিক ধর্ম আছে—সেগুলোর ক্ষেত্রে ঘটেছে ঠিক উল্টোটা। গত কয়েক শতাব্দীতে “আধুনিকতা” যুগিয়েছে তীব্র ধর্মীয় উন্মাদনার স্বাদ; পেয়েছে একচেটিয়া প্রচার-প্রসার আর ঘটিয়েছে ইতিহাসের কয়েকটি ভয়ঙ্করতম রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। এই সময়ে যেসব জাগতিক ধর্ম মাথা তুলেছে তাদের মধ্যে আছে লিবারেলিজম, সমাজতন্ত্র, পুঁজিবাদ, জাতীয়তাবাদ ও নাৎসীবাদের মতো ধ্যান-ধারণা। অনেকে এগুলোকে ধর্ম বলতে চান না, বরং মতাদর্শ হিসেবে দেখতে চান—আদতে এগুলা স্রেফ শব্দের খেলা। যদি ধর্মকে আমরা “মানুষের চেয়ে উচ্চতর কোনো শক্তিতে বিশ্বাস রেখে মানুষের পালিত আচার-আচরণ” বলে সংজ্ঞায়িত করি—তাহলে ধর্ম হিসেবে সোভিয়েত সাম্যবাদ ইসলামের চেয়ে কোনোভাবেই কম যায় না।❞
স্যাপিয়েন আ ব্রিফ হিস্ট্রি অফ হিউম্যানকাইন্ড
অনেকে বিশ্বাস করে—রাষ্ট্র থেকে ধর্মকে আলাদা করলেই শান্তির সুবাতাস বয়ে যাবে! কিন্তু ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়—সেক্যুলার ব্যবস্থা নিজেই যুক্তির দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়নি, হয়েছে সহিংসতার দ্বারা। এনলাইটেনমেন্টের দর্শনের উপর দাঁড়ানো বিভিন্ন সেক্যুলার মতাদর্শ ফরাসি বিপ্লবের রক্তগঙ্গা ও ‘ত্রাসের রাজত্ব’ (Reign of Terror) থেকে শুরু হয়ে ইউরোপসহ বাকি বিশ্বে জন্ম দিয়েছে গণহত্যা, লাশের স্তুপ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের কালোপাহাড়। ১ম বিশ্বযুদ্ধ (মৃত প্রায় ২ কোটি, আহত প্রায় ৩ কোটি), ২য় বিশ্বযুদ্ধ (মৃত ৩.৫-৬ কোটি), চীনের গৃহযুদ্ধ (মৃত ২৫ লক্ষ), কঙ্গো ফ্রি স্টেট (মৃত ৮০ লক্ষ), কোরিয়ান যুদ্ধ (মৃত ২৮ লক্ষ), ২য় ইন্দোচীন যুদ্ধ (মৃত ৩৫ লক্ষ), বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ইত্যাদি (অল্পকিছু উদাহরণ দেয়া হলো) এসব কোনোটাই ধর্মীয় কারণে হয় নি। প্রথম পারমাণবিক বোমা হামলাও হয়েছিল সেক্যুলার প্রগতিবাদীদের হাতে। বিশশতকের সেক্যুলার যুদ্ধে নিহতের সংখ্যাই প্রায় ৮.৭৫ কোটি! সামগ্রিক মৃত্যুর তালিকা করলে এক হিসেবে অন্তত তা প্রায় ১৭.৫ কোটিতে পৌঁছবে! আদতে পৃথিবীর ইতিহাসে অধিকাংশ যুদ্ধই হয়েছে জাগতিক স্বার্থের উস্কানিতে। এনসাইক্লোপিডিয়া অব ওয়ার অনুযায়ী মানব ইতিহাসে সংঘটিত হওয়া ১৭৬৩টি যুদ্ধের মাত্র ১২৩টি ধর্মীয় যুদ্ধ ছিল। অর্থাৎ মাত্র ৭ শতাংশ! সাথে আবার রয়েছে ডেমোসাইড। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক রুডলফ রামেল দেখিয়েছেন আধুনিক কালে সেকুলার সরকারের দ্বারা লম্বা সময় ধরে নাগরিক হত্যার পরিমান অনেক বেশি। রাজনৈতিক স্বার্থের বলি হওয়া এতসব প্রাণ নাস্তিক্যবাদি বা সেকুলার ব্যবস্থা এড়াতে পারে? খোদাবিহীন নানাবিধ জীবনব্যবস্থা ধর্ম ও ধার্মিকদের চেয়ে বহুগুণে সহিংস হওয়ার পরও নাস্তিক ও সেকুলাররা সহিংসতার দায় খুব সফলভাবে স্রেফ ধার্মিকদের উপর চাপাতে পেরেছে। এটাও এক প্রকারের সহিংসতা, এপিস্টেমিক ভায়োলেনস বা জ্ঞানতাত্ত্বিক সহিংসতা।
লিবারেল সমাজের ভিত্তিমূলে থাকা অন্যতম মিথ হলো—ধর্ম মজ্জাগতভাবে সহিংসতার আকর। অথচ অ্যাকাডেমিক গবেষক ও বিশেষজ্ঞরা এ ব্যাপারে একমত যে—জঙ্গিবাদের মূল কারণ ধর্ম নয়। ধর্মের চেয়ে বরং রাজনীতি বেশি প্রভাব রাখে। তারপরও সেই মিথকে পূঁজি করে লিবারেল সমাজ ধর্মের নামে ঘটা সহিংসতার তীব্র নিন্দা জানালেও পশ্চিমা মতাদর্শ—সেক্যুলারিজম, রাষ্ট্র বা জাতিভিত্তিক সহিংসতা ও নির্যাতনকে বৈধতা দেয়, সমর্থন করে। অর্থাৎ স্ট্রাকচার্ড বা কাঠামোগত সহিংসতাকে তারা প্রমোট করে, এর বিরুদ্ধে রেজিস্টেন্স বা প্রতিবাদিদের উপর সহিংসতার দায় চাপিয়ে দেয়। কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পণ্ডিত অধ্যাপিকা জ্যানেট জ্যাকবসেন ঠিকই বলেছেন:
❝সেক্যুলাররা ধার্মিকদের চেয়ে কম সহিংস নয়—বরং তার চেয়েও বেশি সহিংস বলা চলে। ধর্মীয় আচার, সম্প্রদায় ও জীবনদর্শনের তুলনায় সেক্যুলার মতাদর্শ আরো অধিক, তীব্র ও লাগামছাড়া সহিংসতা জন্ম দিয়েছে।❞
Janet R. Jakobsen, Is Secularism Less Violent than Religion? in: Interventions: Activists & Academics Respond to violence
অভিজিত রায়ের মত হাতসাফাইওয়ালারা সত্য এড়িয়ে গেলে কী হবে, নামকরা ব্রিটিশ লেখক ও (নাস্তিক) দার্শনিক অধ্যাপক জন গ্রে নিজে নাস্তিক হওয়া সত্ত্বেও ঐতিহাসিক বাস্তবতা স্বীকার করেছেন। তিনি সেভেন টাইপস অফ এথিইজম গ্রন্থে লিখেছেন:
❝প্রচলিত ধারণা হলো নাস্তিকতা কোনো ধর্মে বিশ্বাসী নয়। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় নাস্তিকতা অনেক সেকুলার ধর্মের খোরাক হয়েছে। নাস্তিকতা যখন সংঘবদ্ধভাবে প্রচারিত হয়েছে তখন প্রচলিত ধর্মের লেবাস গায়ে জড়িয়ে নিয়েছে অজান্তেই। ফরাসি বিপ্লবকালের যুক্তির ধর্ম থেকে শুরু করে অগাস্ট কোঁত-এর মানবধর্ম ও হেকেলের মনিজম, লেনিনের দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ ও আয়ান রান্ড কর্তৃক নিৎশের সুপারম্যান ধারণার পুনঃপ্রচার—নাস্তিকতাপন্থি আন্দোলনগুলো ছুপাধর্মের বাহক হয়েছে বরাবরই। … ফরাসি বিপ্লবের সময় উপাসনাগৃহগুলো লুটতরাজ চালিয়ে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছিল যুক্তি ও মানবতার ধর্ম প্রতিষ্ঠার নামে। সোভিয়েত ইউনিয়নে সকলধর্মের যাজকদের আদিমানব বানিয়ে নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছিল। কাতারে কাতারে তাদের ও তাদের পরিবারের লোকদের হত্যা করা হয়েছে, বন্দিশিবিরে অনেকে ধুঁকে ধুঁকে মরেছে! এসবই ঘটেছে ‘বৈজ্ঞানিক নাস্তিকতা’ প্রচারের নামে। মাও সে-তুংয়ের চায়নাতে অগণিত মন্দির গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে। তিব্বতের সভ্যতা তো প্রায় পুরোটাই ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয়া হয়েছিল। … বিশ শতকের অধিকাংশ সময় জুড়ে সেক্যুলার বিশ্বাসের খেদমতে ভয়ানক সহিংসতা সংঘটিত হয়েছে। আর এই শতকের সংঘবদ্ধ নাস্তিকতা হলো মূলত মিডিয়ার ফসল, একে কেবল বিনোদন হিসেবে মূল্যায়ন করাই যথার্থ।❞
সেভেন টাইপস অফ এথিইজম, পৃ. ২২-২৩
একবিংশ শতকে ওয়ার অন টেরর নাম দিয়ে রাষ্ট্রিয় সহিংসতা হলো লিবারেল সেকুলার গণতন্ত্রীদের আরেক অপকর্ম। এতেও নব্য-নাস্তিকেরা উৎসাহ যুগিয়েছে। (নিধর্মী) ইংরেজ অধ্যাপক টেরি ইগেলটনের ভাষায়:
❝ডকিনস ও তার দোসররা ওয়ার অন টেররে হাতিয়ার হিসেবে কাজ করেছে। পশ্চিমা আধিপত্যবাদের ভিত্তি এখন বাইবেল থেকে নাস্তিকতার দিকে সরে এসেছে।❞
সুতরাং আমরা সহজেই বুঝতে পারি নাস্তিক ও নাস্তিক্যবাদি সেকুলার ব্যবস্থা দাঙ্গা-হাঙ্গামা-যুদ্ধ-সহিংসতার অন্যতম প্রধান কারণ। এই বাস্তবতাকে আড়াল করার জন্য জ্ঞানগত সহিংসতার আশ্রয় নেয়া আরেকটি গুরুতর অপরাধ।
বক্ষ্যমান প্রবন্ধটি রাফান আহমেদ-এর অবিশ্বাসী কাঠগড়ায় গ্রন্থ থেকে তথ্য নিয়ে সাজানো।