“১১ সেপ্টেম্বরই মধ্য এশিয়ায় মার্কিন অভিযানের প্রকৃত বা সত্য কারণ নয়। আফগান শাসকরা… ওসামা এবনে লাদেনকে ঠাঁই দিয়েছে। মার্কিন উপরোধ উপেক্ষা করে তাকে রেহাই দিয়েছে, পাকড়াও করে তাদের হাতে তুলে দেয়নি। তাই আমরা আফগান বেটাদের উপর চড়াও হয়েছি—যুক্তিবাদী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই কৈফিয়ত দয়া করেই দিয়েছে। না দিলেও কারও কিছু বলার ছিল না। ওদিকে আবার সাবেক রাষ্ট্রপতি বিল ক্লিনটন প্রচার করেছেন—১১ সেপ্টেম্বর তারিখের অনেক আগেই তিনি শ্রীমান লাদেনকে খুন করার হুকুম জারি করে বসেছিলেন। এই সেই ক্লিনটন যিনি কোন দিন কোন মিথ্যাকথা বলেন নাই। তাই পৃথিবীও তাহার কথা অবিশ্বাস করে নাই।
তার প্রমাণও মেলে সুদানে, সোমালিয়ায়, এরাকে এবং (বলা বাহুল্য) খোদ আফগান দেশে। তো বলা চলে, লাদেন-বিরোধী অভিযানের ইতিহাসে ১১ সেপ্টেম্বর একটি বাড়তি অধ্যায় বৈ নয়। বাংলায় বলি, কারণ-বোঝার উপর করুণ-শাকের আটি। তবু প্রশ্ন থেকেই গেল: খুদে আফগান জাতির উপর মহান দেশের এই মহা গোস্বার সত্য কারণ কী?
যুক্তরাষ্ট্র বার বার বলেছে—তাদের যুদ্ধ ক্রুসেড বটে, তবে এ ক্রুসেড সে ক্রুসেড নয়। এর প্রতিপক্ষ আফগান জাতি নয়, শুদ্ধ তালেবান শাসকগণ৷ এর প্রতিপক্ষ এসলাম ধর্ম নয়, (এসলাম মার্কা) সন্ত্রাসবাদ মাত্র। আমেরিকার এই কথা ও তার যুদ্ধপ্রয়াসের মধ্যে সঙ্গতি আবিষ্কারের চেষ্টা শতাব্দীর মনীষার কাজ, সন্দেহ নাই। রাষ্ট্রপতি বুশ বলেন: সন্ত্রাসীর বিরুদ্ধে তার দেশের অভিযানের মাঝখানে দাঁড়াবার অধিকার কারও নাই। পয়গম্বর হজরত ইসা এবনে মরিয়মের বাক্য উদ্ধার করে তিনি বলেন, যারা আমাদের পক্ষে নাই তারা আমাদের শক্রপক্ষের লোক।
এ কথার অর্থ ভয়াবহ। এমন ভয়াবহ যে আমাদের পক্ষে এর অর্থ হজম করাও কঠিন। এই কথায় নির্গলিতার্থ: আমরা সারে জাহার বিরুদ্ধে জঙ্গ ঘোষণা করলাম। ভয়ে বা প্রলোভনে পাকিস্তান, ভারত ও বাংলাদেশ প্রভৃতি রাষ্ট্র এর মধ্যেই মার্কিন জোটে যোগ দিয়েছে। যারা দেয় নাই যুক্তরাষ্ট্র এখন ইচ্ছা করলে তাদের ঘাড়েও সিন্দাবাদের দৈত্যের মতন লাফ দিয়ে বসতে পারে। তো সামান্য লাদেনের শাক ঢাকতে কেন এত মাছের আমদানি? কেন কামান দাগতে এই মশার চাষ, মশাই? কেন আমেরিকা বনাম পৃথিবীর এই আড়াই নম্বর বিশ্বযুদ্ধ?
কারণ, আমাদের বিবেচনায়, বিদ্রোহ। আফগানরা একদিন মার্কিন দেশের মিত্র ছিল। এখন বিদ্রোহ করছে। এ বিদ্রোহ মেনে নেওয়া যায় না। আফগানিস্তানের মতন নগণ্য কোন দেশ জোটের বাইরে গেলে ছাইপাঁশ আসে না কিন্ত উদাহরণের শক্তি অপরিমেয়। ক্ষুদ্র আফগান দেশ যদি উদাহরণ স্থাপনের সুযোগ পায়, তো কাল বড়সড় দেশ সৌদি আরবও যে সেই পথ ধরবে না তার কসম কোথায়? মার্কিন সাম্রাজ্যের আজ আর কোন প্রতিদ্বন্দ্বী নাই । আজ সে নিজেই নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী ।
তবু কেন এমন নিষ্ঠুরতা? কেন তার শরণ নিতে আজ সে পিছ পা হচ্ছে গা? দুনিয়ার আর দশ দেশকে শিক্ষা দেওয়াই আফগানিস্তানে মার্কিন যুদ্ধের প্রধান কারণ। এই দরিদ্র দেশের সঙ্গে কোন প্রকার আলাপ আলোচনায় বসাও আমেরিকার মর্যাদার সঙ্গতিপূর্ণ নয়। যুক্তরাষ্ট্র সরকার ও তার মিত্রদের জবরদস্তির এবং আত্মগরিমার এটাই আশু কারণ। এর সুদূর মূল এই সাম্রাজ্যের ভিত্তিতে বটে । সারা পৃথিবীর প্রাণ না নিয়ে আজ এ সাম্রাজ্য আয়ুর নিশ্চয়তা নিতে পারছে না।…
আফগানিস্তানে আমেরিকার নিষ্ঠুরতাকে অনেকের মনে হবে ন্যায়বিচার। সন্ত্রাস দমনের অপরিহার্য আনুষঙ্গিক ক্ষয়ক্ষতি। আবার অন্য অনেকের মনে হবে এই সন্ত্রাসের সত্য কারণ আমেরিকার সাম্রাজ্য। সাম্রাজ্যটা কেটে বাদ দিলে আফগান আর আমেরিকান জনগণের কোন বিবাদ নাই। সাম্রাজ্য আছে। তাই যুদ্ধ আছে। কারও কাছে এই যুদ্ধ স্বাভাবিক, সুতরাং সঙ্গত । আর কারও কাছে এ যুদ্ধ সাম্রাজ্যের ফল, অতয়েব নিষ্ঠুর ।
আমেরিকার হাত থেকে আফগানিস্তান কি রেহাই পাবে? পেলে তা কিভাবে? হয় খোদ আমেরিকার নীতি বদলালে, নয় আফগান সরকারের পতন ঘটলে। আমেরিকার নীতি দুই চার দশ বছরে বদলানোর সম্ভাবনা যখন নাই তখন ধরে নেওয়া যায় আফগানিস্তানে সরকার বদলাবে। কিন্তু মার্কিন নিষ্ঠুরতার কি অবসান ঘটবে তাতে?”
ড. সলিমুল্লাহ খান, আদমবোমা; পৃ. ১৩০-১৩৬ (ঢাকা: আগামী প্রকাশনী, ২০১৩)