Physician | Author | Blogger

ফ্রয়েড নিয়ে সাম্প্রতিক ভাবনা

এক নজরে

মূল: বেঞ্জামিন প্ল্যাকেড । লাইভ সায়েনস – অনুবাদ: রাফান আহমেদ

সিগমুন্ড ফ্রয়েড (১৮৫৬-১৯৩৯) ছিলেন নামকরা অস্ট্রিয়ান মনোবিজ্ঞানী। মানবের অবচেতন মনের গহীনে প্রবেশের চেষ্টাকারী ডাক্তারদের মাঝে তিনি ছিলেন অন্যতম। কিন্তু তিনি যা বলেছিলেন তার কোনোকিছুর কী বৈজ্ঞানিক ভিত্তি আছে? মনে হয় না।

তার নানাবিধ ধারণার মাঝে সবার আগে যেটার কথা মনে আসে তা হলো—আমরা সবাই নাকি আমাদের পিতামাতার সাথে যৌনক্রিয়ার প্রকৃত আকাঙ্খা দমিয়ে রাখছি। কিন্তু মুশকিল হলো, ফ্রয়েড বিজ্ঞান ব্যবহার করে এই ধারণায় উপনীত হন নি। তিনি প্রথমে একটা তত্ত্ব দাঁড় করিয়েছেন তারপর উল্টোদিকে গিয়ে সুবিধাজনক উপাত্ত খুঁজে-খুঁজে বেছে নিয়েছেন তার বিশ্বাসকে টিকিয়ে রাখার জন্য। যে-সকল তথ্য-উপাত্ত তার ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করেছে সেগুলোকে তিনি গলার জোরে উগ্রভাবে অগ্রাহ্য করেছেন—বলে মত দিয়েছেন ড. ফ্রেডেরিক ক্রু। তিনি হলেন ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় বার্কেলে এর ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ও ফ্রয়েডের সাবেক গুণমুগ্ধ ভক্ত। এক সাক্ষাতকারে লাইভ সায়েনস-কে তিনি বলেন:

“ফ্রয়েড যেন জোর করে নিজেকে বিজ্ঞানী বানাতে চাইতেন। কোনো রকমের আপত্তি তার পছন্দ হতো না। আপত্তি শুনলেই তা হেসে উড়িয়ে দিতেন এবং আপত্তিকারী ব্যক্তিকে মানসিকভাবে অসুস্থ সাব্যস্ত করতেন।”

ফ্রয়েডের মুলনীতির যথার্থতা যাচাই করার মানসে ২০১৭ সালে অধ্যাপক ক্রু ফ্রয়েড: দ্য মেকিং অফ অ্যান ইল্যুশন (মেট্রোপলিটন বুকস প্রকাশনী) বইটি লিখেন। তিনি বলেন:

“পরিসংখ্যান বিচার করলে ফ্রয়েডের মত একজন অসৎ ও ধূর্ত ব্যক্তিও সঠিক কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারেন। আমি তাই সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি তার তত্ত্বগুলোকে যাচাই করতে, বারবার প্রশ্ন করেছি—তার অমুক সিদ্ধান্তের পেছনে বস্তুগত প্রমাণ কি ছিল? আপনি যদি এ ধরণের প্রশ্ন করতে থাকেন তাহলে একসময় আমার মত আপনিও আশাহত হবেন।।”

সাম্প্রতিক কালে প্রকাশিত ফ্রয়েডের ধারনাগুলোর বিশ্লেষণ নিয়ে পশ্চিমা বিদ্যানদের বই। এবিষয়ে সায়েন্টিফিক আমেরিকানের এডিটর জন হোরগানের আর্টিকেলটিও প্রাসঙ্গিক। পড়ুন এখানে: Why Freud Should Be Dead

কথাগুলো এখন শুনতে খারাপ লাগছে হয়তো। অথচ মনোসমীক্ষণের জনক হিসেবে খ্যাত ফ্রয়েড তার সময়ে সেলিব্রেটি ছিলেন, বিশশতকের বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তিনি ভাবতেন মানসিক সমস্যাগুলো নিরাময়ের জন্য মানবের অবচেতন মনের ভাবনাগুলোকে সচেতন দশায় নিয়ে আসা দরকার। ফ্রয়েডের নানারকম ধারণার মাঝে প্রধান ছিল ইডিপাস কমপ্লেক্স অনুকল্প। এই অনুকল্প অনুসারে, প্রতিটি কিশোর তার মায়ের সাথে যৌনক্রিয়া করতে চায়, কিন্তু সে দেখে স্বীয় পিতা এই রতিক্রিয়ার পথে তার প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাই সে পিতাকে হত্যা করতে চায়। কিন্তু সে থেমে যায় যখন বুঝতে পারে পিতা আসলে তাকে অভিভাবক। এই দোটানার মুখে পড়ে বাচ্চাটা তার জিঘাংসার প্রবল অভিলাষ দমন করতে বাধ্য হয়। অধ্যাপক ক্রু বলেন, ‘এমন আজগুবি ধারণা মনে হয় আর কেউ দেয় নাই’। লোকে যখন ফ্রয়েডকে মেয়ে শিশুর ব্যাপারে প্রশ্ন করলো তখন সে আরেকটা আইডিয়া নিয়ে এল—দ্য ইলেক্ট্রা কমপ্লেক্স। ড. ক্রু বলেন, ‘এটা স্রেফ কাট-পেস্ট এর কারবার। হঠাৎ করে ছোটমেয়েটি এখন তার বাবার সাথে সেক্স করতে চায়। একেবারে আজগুবি কথাবার্তা এসব।’

উভয় ধারণার ক্ষেত্রেই দমিত আবেগের ব্যাপারটা লক্ষ্যনীয়। আর এর দ্বারাই ফ্রয়েড তার সমালোচকদের খারিজ করে দিতেন। ড. ক্রু পর্যবেক্ষণ করেছেন:

“ফ্রয়েড সবসময় মনে করতেন তিনি রোগীর সমস্যা সম্যকভাবে জ্ঞাত এবং রোগিয়ে শাসিয়ে, চোখ রাঙ্গিয়ে হলেও তিনি তা মানতে বাধ্য করতেন। রোগীরা একমত না হলেও তিনি কখনোই এটা মানতে চান নি যে-তার ভুল হতে পারে। রোগীকে ঠেকাতে তিনি তার প্রিয় ‘দমিত আবেগ’-এর ধারনা টেনে আনতেন। তিনি নিজেকে বুঝাতেন-রোগী আসলে অবচেতন মনে ফ্রয়েডের সাথে একমত কিন্তু সেই ধারণাগুলো সামাল দিতে রোগী খুব ভয় পাচ্ছে। (বিজ্ঞানের গণ্ডীতে) কোনো ধারণা যাচাইয়ে যা করা হয় ফ্রয়েড তার ঠিক উল্টোটা করতেন।”

তবে ফ্রয়েডের সমালোচকদের সবাই ড. ক্রু এর মতো এত খুঁটিনাটি ভাবেন নি। হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের মনোরোগবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক রবার্ট স্টিকগোল্ড মনে করেন:

“স্বপ্নের ব্যাখ্যায় ফ্রয়েড যে ‘ডে রেসিডিউ’-এর কথা বলেছিলেন তা ঠিক বটে। তবে মনোসমীক্ষণের আগাগোড়া এবং শিশুর যৌনতা নিয়ে তিনি যা বলেছেন তা পুরোপুরি পাগলামি।”

ডে রেসিডিউ সম্পর্কে আমরা অনেকেই জানি। আমাদের বাস্তব জীবনে যা ঘটে তারই কিছু অংশ স্বপ্নের জগতে ঢুকে পড়ে। ফ্রয়েডের মাথায় ধারণার বাম্পার ফলন হয়েছিল। যৌনবিকৃতি, নারীদের ‘হিস্টিরিয়া’, মানুষের সজাগ দশার থেকে বিচ্ছিন হয়ে মস্তিষ্কে অবচেতন স্মৃতির বিচরণ—ইত্যাদি নানা বিষয়ে মত দিতে পারলে তিনি তৃপ্ত হতেন। তবে কোনো কোনো পর্যবেক্ষকের মতে এখানেই ফ্রয়েডের আপাত প্রতিভা লুকিয়ে আছে। নতুন ইয়র্ক শহরে অবস্থিত ফর্ডহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. হ্যারল্ড টাকোশিয়ান ব্যাখ্যা করেন:

“ফ্রয়েড ছিলেন আইডিয়ার কারখানা। কখনো তথ্য-উপাত্ত নিয়ে মাথা ঘামান নি তিনি। তার আশা ছিল অন্যেরা তার ধারণাগুলোকে নিয়ে খাটাখাটনি করে সেগুলোকে সঠিক বা ভুল প্রমাণ করুক গিয়ে।”

অধ্যাপক ক্রু দেখেছেন, মোটের উপর ফ্রয়েডের তত্ত্বগুলো বিজ্ঞানের মত করে পরিসংখ্যান দিয়ে যাচাই করা প্রায় অসম্ভব। তিনি বলেছেন: “কারণ তার তত্ত্বগুলো অস্পষ্টতা দেখে আশাহত হওয়া ছাড়া উপায় নেই। এগুলোকে আপনি কীভাবে যাচাই করবেন? এসব তো স্রেফ বুলি কপচানোর শামিল।”


মূল আর্টিকেল: Benjamin Plackett, Was Freud right about anything? Live Science

Share This
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp
Share on email
Related Articles
Recent Articles

রাফান আহমেদ-এর বইসমূহ

আলাদাবইওয়াফিলাইফ

Copyright © Rafan Ahmed

No part of the website or posts can be published elsewhere without prior permission from author.  

Copyright © 2021 All rights reserved

error: Content is protected !!